ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মোঃ শারফুদ্দিন আহমেদ

গণতন্ত্রের উত্তরণ ও ডা. মিলন

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ২৭ নভেম্বর ২০১৪

গণতন্ত্রের উত্তরণ ও ডা. মিলন

ঢাকা ১৯৯০ সাল। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে, লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের বয়স মাত্র ২০ বছর। যে লক্ষ্য নিয়ে ১৯৭১ সালে তৎকালীন বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এ দেশের ছাত্র-যুবক, শিক্ষক-চিকিৎসক, কৃষক-শ্রমিক-জনতাসহ সকল পেশার মানুষ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিল, তা স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় দেশী-বিদেশী চক্রান্তে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার মাধ্যমে লক্ষ্যচ্যুত হয়। জেনারেল জিয়ার প্রত্যক্ষ সহায়তায় ও পাকিস্তানী ষড়যন্ত্রকারীদের পরিকল্পনায় বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর আবারও এ দেশের মানুষের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয় অগণতান্ত্রিক সামরিক স্বৈরশাসন। সেই স্বৈরশাসকের নাগপাশ ছিন্ন করে গণতন্ত্রে উত্তরণের বছর হিসেবে আমাদের মাঝে উপস্থিত হয়েছিল ১৯৯০ সাল। ১৯৯০ সাল ঢাকার রাজপথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নেমে এসেছিল সকল মতের, সকল পেশার মানুষ। এ সব গণমানুষের লক্ষ্য একটাই ‘স্বৈরশাসকের পতন, গণতন্ত্রের উত্তরণ।’ তাই ঢাকা শহর পরিণত হয়েছিল মিছিলের নগরীতে। বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা ও চিকিৎসা পেশার সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশের চিকিৎসকদের জাতীয় সংগঠন বাংলাদেশ মেডিক্যাল এ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) ২৩ দফার ভিত্তিতে যখন অগণতান্ত্রিক সামরিক স্বৈর সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে ঠিক তখনই সামরিক স্বৈরাচারের দোসর ডা. জাফরুল্লাহ গংদের সহায়তায় ১৯৯০ সালে এ দেশের জনগণের ওপর টিক্কা খান স্টাইলে চাপিয়ে দেয়া হয় গণবিরোধী স্বাস্থ্যনীতি। ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধসহ প্রতিটি গণতান্ত্রিক ও স্বাধিকার আন্দোলনে পেশাজীবীদের মধ্যে সর্বোচ্চ আত্মদানকারী চিকিৎসক সমাজ অন্যায়ভাবে চাপিয়ে দেয়া গণবিরোধী স্বাস্থ্যনীতির বিরুদ্ধে অন্য সকল পেশাজীবীদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে স্বৈারাচারবিরোধী গণআন্দোলনকে আরও বেগবান করে। ২৭ নবেম্বর ১৯৯০। সারাদেশে স্বৈরাচার সামরিক সরকারবিরোধী আন্দোলন তখন তুঙ্গে। বিএমএর নেতৃত্বে ধারাবাহিক আন্দোলনের অংশ হিসেবে সারাদেশে চলছিল চিকিৎসকদের কর্মবিরতি। তৎকালীন পিজি হাসপাতালে চলছিল বিএমএ আহূত চিকিৎসক সমাবেশ। চিকিৎসক সমাবেশে যোগদানের লক্ষ্যে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে রিক্সাযোগে শাহবাগ পিজি হাসপাতালের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন তৎকালীন বিএমএর মহাসচিব ডাঃ মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন ও যুগ্মসম্পাদক ডাঃ শামসুল আলম খান মিলন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিসংলগ্ন টিএসসি মোড় অতিক্রমকালে তাঁদের রিক্সা লক্ষ্য করে গুলি চালায় সামরিক জান্তাবাহিনী। বুকে গুলি লেগে রিক্সা থেকে লুটিয়ে পড়েন ডাঃ শামসুল আলম খান মিলন। সঙ্গে সঙ্গে রিক্সায় করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে জরুরী অস্ত্রোপচার করেও বাঁচানো যায়নি স্বৈরাচারবিরোধী গণঅভ্যুত্থানের সাহসী সৈনিক ডাঃ মিলনকে। তাঁর প্রিয় মেডিক্যাল কলেজের অস্ত্রোপচার কক্ষেই সকলকে কাঁদিয়ে শহীদের বেশে তিনি চলে যান না ফেরার দেশে। যে কলেজে তিনি পড়েছেন মেধাবী ছাত্র হিসেবে, পড়িয়েছেন বিনয়ী শিক্ষক হিসেবে, নেতৃত্ব দিয়েছেন প্রাঞ্জল সদালাপী পরমতসহিষ্ণু ব্যক্তি হিসেবে। ডাঃ মিলন শহীদ হওয়ার পর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন আরও বেগবান হয়; ৬ ডিসেম্বর ১৯৯০ পতন ঘটে স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের। গণতন্ত্রের উত্তরণের পথে প্রাথমিক বিজয় সূচিত হয়। স্বার্থক হয় মিলনের আত্মদান। শহীদ ডাঃ শামসুল আলম খান মিলন একটি অনন্য অসাধারণ নাম। তিনি ১৯৫৭ সালের ২৯ জানুয়ারি বর্তমান লক্ষ্মীপুর জেলায় জন্মগ্রহন করেন। ১৯৭৫ সালের ২ ডিসেম্বর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে প্রথমবর্ষে ভর্তি হয়ে ১৯৮৩ সালে এমবিবিএস পাস করে চিকিৎসক হিসেবে কর্মময় জীবন শুরু করেন। ঢাকা মেডিক্যালে ইন্টার্নশিপ চলাকালীন তিনি ইন্টার্নি চিকিৎসক সংগঠনের আহ্বায়ক ছিলেন। শিক্ষক হিসেবে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ শিক্ষক সমিতির নির্বাচিত কর্মকর্তা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। ডাঃ শামসুল আলম খান মিলনের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগতভাবে কাজ করার সুযোগ হয় ১৯৮৮ সাল থেকে। তখন বিএমএ নির্বাচনে দুটি প্যানেলে নির্বাচন হয়Ñ একটি ডাঃ মাজেদ-মাহবুব পরিষদ আর অন্যটি ডাঃ সারওয়ার-জালাল পরিষদ। ডাঃ মাজেদ-মাহবুব পরিষদ থেকে মাত্র দুটি পদে ডাঃ এমএ মাজেদ সভাপতি ও ডাঃ শামসুল আলম খান মিলন যুগ্মসম্পাদক পদে নির্বচিত হন। মহাসচিব পদে ডাঃ মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনসহ বাকি পদগুলোতে নির্বাচিত হয় ডাঃ সারওয়ার-জালাল পরিষদ। আমি নির্বাচিত হই দফতর সম্পাদক পদে। সেই থেকে একই সঙ্গে সংগঠনের হয়ে কাজ করা। দুটি ভিন্ন প্যানেল থেকে আমরা নির্বাচিত হলেও বিএমএর কাজে বা পেশাগত কোন বিষয়ে আমাদের মধ্যে বড় ধরনের কোন মতপার্থক্য পরিলক্ষিত হতো না। একে অপরের সহযোগী বা পরিপূরক হিসেবে পেশার জন্য অটল থেকে কাজ করেছি। তিনি চিকিৎসকদের মধ্যে বিশেষ করে তরুণ চিকিৎসকদের মাঝে বেশ জনপ্রিয় ছিলেন, যা তাঁর নির্বাচিত হয়ে আসা থেকেই পরিলক্ষিত হয়। বিএমএর কার্যক্রমে অভিন্ন মনোভাব নিয়ে আমরা সকলে কাজ করি এবং সকল আন্দোলনে জেল-জুলুম, ভয়-ভীতির উর্ধে থেকে মিলন ও আমরা ছিলাম নির্ভীক। ১৯৯০ সালের ২৭ জুলাই বিএমএর বিশেষ বার্ষিক সাধারণ সভায় গণবিরোধী স্বাস্থ্যনীতি ও স্বৈরশাসকের অন্যায় অথ্যাচারের প্রতিবাদে সকল চিকিৎসক সরকারী চাকরি থেকে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন। মঞ্চ থেকে নেমে আমি আর মিলন একসঙ্গে দাঁড়িয়ে কথা বলছি। ওই সময় বিবিসি রেডিও টেলিফোনে বিএমএ নেতাদের সাক্ষাতকার নেয়। ১৯৯০ সালের ২৭ জুলাই রাতে বিবিসি রেডিওতে আমার যে সাক্ষাতকারটি প্রচারিত হয় তাতে মিলন পাশে থেকে বিভিন্ন বিষয়ে বলতে সহযোগিতা করেছিলেন। আজ ২৭ নবেম্বর ২০১৪। গণতন্ত্রের লড়াকু সৈনিক শহীদ ডাঃ শামসুল আলম খান মিলনের ২৪তম শাহাদতবার্ষিকী। দেখতে দেখতে চব্বিশটি বছর কেটে গেল। সহযোদ্ধা ডাঃ মিলনের শাহাদতবার্ষিকীতে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আমার মন ভারাক্রান্ত। ডাঃ মিলনের মৃত্যু কোন স্বাভাবিক মৃত্যু ছিল না। এ আত্মদান ছিল দেশের সাধারণ ও বৃহত্তর মানুষের মঙ্গলের জন্য। ডাঃ মিলন অতিমাত্রায় একজন সমাজ সচেতন মানুষ ছিলেন। তাঁর অপরিসীম ভালবাসা ও শ্রদ্ধাবোধ ছিল এ দেশের হাজার হাজার চিকিৎসকদের প্রতি, চিকিৎসা পেশার প্রতি, সাধারণ মানুষের প্রতি, গণতন্ত্রের প্রতি। মাঝে-মধ্যে হোঁচট খেলেও বাংলাদেশে গণতন্ত্রের বয়সও চব্বিশ বছর। ডা. মিলন যে আদর্শ ধারণ করে, যে লক্ষ্যকে সামনে রেখে সংগ্রাম করতে করতে আত্মাহুতি দিয়েছিল অনেক হতাশার পর ১৯৯৬-২০০১ ও ২০০৮-বর্তমান সময় পর্যন্ত মেয়াদে দায়িত্বরত জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পরিচালিত গণতান্ত্রিক সরকার তার অনেকটাই বাস্তবায়িত করেছে। গণমুখী জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি-২০১২ প্রণয়ন, ১৩৬২ আইএসটি শিক্ষক-চিকিৎসকদের চাকরি নিয়মিত করা, ডিপিসির মাধ্যমে হাজার হাজার চিকিৎসক-শিক্ষক-কর্মকর্তার পদোন্নতি, নতুন নতুন পদ ও বিভাগ সৃষ্টি, বেকার চিকিৎসকদের কর্মসংস্থান, চিকিৎসকদের মর্যাদা বৃদ্ধি, নতুন নতুন সরকারী মেডিক্যাল কলেজ-নার্সিং কলেজ প্রতিষ্ঠা, শিশু-মাতৃ মৃত্যুহার হ্রাস, স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় ডিজিটাল পদ্ধতি প্রবর্তন, গড় আয়ু বৃদ্ধি, কমিউনিটি ক্লিনিকের প্রতিষ্ঠা অন্যতম। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সার্বিক উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশ আজ বিশ্বে রোল মডেল। স্বাস্থ্য খাত উন্নয়নের জন্য সরকার আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জাতিসংঘের এমডিজি এ্যাওয়ার্ড, সাউথ-সাউথ এ্যাওয়ার্ডসহ একাধিক পুরস্কার অর্জন করেছে। সম্প্রতি সরকার সকল জনগণের জন্য স্বাস্থ্যবীমা ও মেডিক্যাল হেলথ কার্ড প্রবর্তনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে, ফলে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় সার্বিক উন্নয়ন পরিলক্ষিত হবে। নতুন জাতীয় ওষুধ নীতি-২০১৪ প্রণয়নের দিকে অনেক দূর এগিয়েছে। স্বাস্থ্য খাতে সেবার মান আরও বৃদ্ধির লক্ষ্যে অচিরেই জাতীয় এ্যাক্রিডিটেশন বোর্ড কাজ করবে। আজকের দিনে আমার প্রত্যাশাÑ বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকার অচিরেই বিসিএস (স্বাস্থ্য) ক্যাডারে নিয়োজিত প্রায় ২৫ হাজার চিকিৎসক কর্মকর্তার সঙ্গে অন্যান্য পেশার বা ক্যাডারের মধ্যে বৈষম্য দূর করবে, কর্মস্থলের চিকিৎসকদের সার্বিক নিরাপত্তা ও চিকিৎসা অবকাঠামো নির্মাণ হবে, স্বাস্থ্য খাতের বাজেট বৃদ্ধি পাবে, ফলে গ্রামীণ জনপদের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য চিকিৎসাসেবার দ্বার প্রসারিত হবে। লেখক : বিএমএর কার্যকরী পরিষদ সদস্য
×