ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

পরীক্ষা ছাড়াই প্যাথলজি রিপোর্ট, ডাক্তারের নকল সই

প্রকাশিত: ০৫:০৮, ২৭ নভেম্বর ২০১৪

পরীক্ষা ছাড়াই প্যাথলজি রিপোর্ট, ডাক্তারের নকল সই

নিখিল মানখিন ॥ পরীক্ষা ছাড়াই দেয়া হয় প্যাথলজি পরীক্ষার রিপোর্ট। কম্পিউটারে সাজানো থাকে রিপোর্ট খাতা। রোগীর তথ্য টাইপ করে প্রিন্ট দিলেই বেরিয়ে আসে পরীক্ষার রিপোর্ট। নকল করা হয় চিকিৎসকের স্বাক্ষর। নেই কোন টেকনিশিয়ান। এমন ভুয়া রিপোর্টের ভিত্তিতেই চিকিৎসা চলে রোগীর। আর চিকিৎসকরাও চালিয়ে যান তাঁদের চিকিৎসা কার্যক্রম। এভাবে ভুল চিকিৎসার শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করেন অনেক রোগী। সোমবার জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের বিপরীতে মোহাম্মদপুরে ‘ন্যাশনাল ডায়াগনস্টিক সেন্টার’ নামে এমন একটি ভুয়া ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সন্ধান পায় ভ্রাম্যমাণ আদালত। সোমবার বেলা সাড়ে এগারটায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের উপস্থিতিতে র‌্যাব-২ এর অভিযান পরিচালিত হয়। তাৎক্ষণিকভাবে মালিক আবদুল বাকী বকুলকে (৪০) ১ বছর কারাদ- ও ২ লাখ টাকা জরিমানা এবং টেকনিশিয়ান সামায়ন আলীকে (২২) ৬ মাসের কারাদ- ও ১ লাখ টাকা জরিমানা করেন মোবাইল কোর্ট। মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেন র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এ এইচ এম আনোয়ার পাশা। র‌্যাব-২ অভিযান পরিচালনা করেন উপ-অধিনায়ক মেজর সৈয়দ সালাহ্্উদ্দিন মাহমুদ। অভিযানে স্বাস্থ্য অধিদফতরের প্রতিনিধি ডাঃ স্বপন কুমার তপাদার উপস্থিত ছিলেন। অভিযানের সময় দেখা গেছে, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি না থাকা সত্ত্বেও পরীক্ষা ছাড়াই রক্ত, মূত্রসহ বিভিন্ন টেস্টের মনগড়া রিপোর্ট প্রদান করা হচ্ছিল। এ সময় রোগী পারভীনের (২৫) কাছ থেকে ১৫শ’ টাকা নিয়ে রিপোর্ট প্রদান করা হয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের মাইক্রোস্কোপটি নষ্ট এবং ব্লাড সেল কাউন্টার নেই। রক্তের সøাইড বানানো ছাড়াই রক্তের টিসি, ডিসি, ডব্লিউবিসি পরীক্ষার মনগড়া রিপোর্ট প্রদান করা হয়। অভিযুক্ত টেকনিশিয়ান সামায়ন আলী জানান, এক মাস আগে মাইক্রোস্কোপটি নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর অনুমানের উপর নির্ভর করে পরীক্ষা ছাড়াই মনগড়া রিপোর্ট তৈরি করা হচ্ছিল। প্যাথলজি ডাক্তার সাইফুল ইসলামের সীল ব্যবহার এবং তাঁর স্বাক্ষর জাল করে ভুয়া রিপোর্ট প্রদান করা হচ্ছিল। রোগীদের কাছ থেকে রক্ত, মূত্র ইত্যাদি লোক দেখানো নমুনা নেয়া হলেও তা বালতিতে ফেলে দিয়ে কম্পিউটার থেকে মনগড়া রিপোর্ট প্রিন্ট করে দেয়া হয়, যা বালতি টেস্ট হিসেবে পরিচিত। নিয়ম অনুযায়ী একজন প্যাথলজি ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে টেকনিশিয়ানের সহযোগিতায় প্যাথলজি পরীক্ষা বাধ্যতামূলক। কিন্তু প্যাথলজি ডাক্তার ছাড়াই মনগড়া রিপোর্ট প্রদান করা হচ্ছিল এবং এমন রিপোর্টের উপর ভিত্তি করেই ডাক্তার ওষুধ প্রদান করে আসছিলেন বলে স্বীকার করেন অভিযুক্ত টেকনিশিয়ান সামায়ন আলী। প্রতিষ্ঠানের মালিক আব্দুল বাকি বকুল অভিযানের সময় রোগীদের এক্স-রে করছিলেন। কিন্তু এ বিষয়ে তাঁর কোন প্রশিক্ষণ না থাকায় ঝুঁকিপূর্ণভাবে এক্স-রে মেশিন চালাচ্ছিলেন। এই এক্স-রে মেশিনের ছাড়পত্রে মেয়াদও উত্তীর্ণ হয়েছে। উচ্চ মাত্রার রশ্মি স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হলেও অভিযুক্তগণ ঝুঁকিপূর্ণভাবে রোগীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করছিলেন। এই প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধ রাখার নির্দেশ প্রদান করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। আশপাশে অনেকগুলো সরকারী হাসপাতাল থাকায় সরকারী হাসপাতালে আসা রোগীদের দালালরা ভুল বুঝিয়ে এখানে নিয়ে এসে ভুয়া প্যাথলজি টেস্ট রিপোর্ট তৈরি করে ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা গ্রহণ করে প্রতারণা করে আসছিলেন। দালালরা ওই টাকার শতকরা ৭০ ভাগ কমিশন পেয়ে থাকে বলে অভিযুক্ত মালিক বকুল জানান। তিনি আরও জানান, সরকারী হাসপাতাল এলাকায় চার শিফটে প্রায় এক হাজার দালাল সক্রিয় রয়েছে। গ্রাম ও জেলায় চিকিৎসা করিয়ে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় আসলে সরকারী হাসপাতালের গেট থেকে ভুল বুঝিয়ে দালালরা রাস্তার অপর পাড়ে বেসরকারী ক্লিনিক ও প্যাথলজি সেন্টারে নিয়ে গিয়ে প্রতারণা করে। র‌্যাবের অভিযানে এরূপ শতাধিক ভুয়া ডাক্তার ও প্যাথলজি সেন্টারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। দ-প্রাপ্ত মোঃ আবদুল বাকি বকুল রংপুর জেলার গঙ্গাচড়া থানার পাকুরিয়া শরীফ গ্রামের মোঃ বেলাল উদ্দিনের ছেলে এবং মোঃ সামায়ন আলী ঠাকুরগাঁও জেলার রানীশংকৈল থানার পদমপুর গ্রামের মোঃ হুমায়ুন কবিরের ছেলে। দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ রয়েছে, রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের সরকারী হাসপাতালগুলোকে কেন্দ্র করে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে অসংখ্য বেসরকারী ক্লিনিক, হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। সরকারী হাসপাতালের রোগী ভাগিয়ে চিকিৎসা বাণিজ্য করাই ওইসব বেসরকারী চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলোর মূল উদ্দেশ্য। কোন কোন প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন নেই বলে অভিযোগ উঠেছে। আবার তাদের কেউ কেউ অনুমোদনের জন্য আবেদন করেই ব্যবসা শুরু করে দিয়েছে। স্থায়ী ভিত্তিতে কোন চিকিৎসক ও নার্স নিয়োগ করা থাকে না। হাসপাতালের অনেক চিকিৎসকের সঙ্গে ওই সব ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের রয়েছে গোপন সমঝোতা। সরকারী হাসপাতালের রোগী ভাগিয়ে আনার জন্য প্রতিটি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান নিযুক্ত করে দালাল চক্র। তাদের অমানবিক বাণিজ্যিক খেলার খপ্পড়ে পড়ে অপচিকিৎসার শিকার হয় অনেক রোগী। ভুল চিকিৎসার পাল্লায় পড়ে অকালে একের পর এক রোগীর মৃত্যু ঘটছে বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য নির্দিষ্ট কোন চার্জ নেই। স্বাস্থ্য সেক্টরের অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে দৃঢ় অবস্থান ব্যক্ত করে সম্প্রতি স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেছেন, কোন অবস্থাতেই অনিয়ম ও দুর্নীতি মেনে নেয়া হবে না। স্বাভাবিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে সরকার। তিনি আরও বলেন, ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে প্রয়োজনীয় খরচের তুলনায় অনেক গুণ চার্জ নেয়া হয়। এটা চলতে পারে না। বেসরকারী হাসপাতালের ক্লিনিকের মালিকরা যদি যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ না করে তাহলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করে পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। মনুষ্য সৃষ্ট দুর্যোগ বন্ধ করতে হবে। অবৈধ ও মানহীন হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হবে বলে জানান স্বাস্থ্যমন্ত্রী।
×