ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ফ্রি স্টাইলে রাস্তা পারাপারের দিন শেষ

প্রকাশিত: ০৫:১৩, ২৬ নভেম্বর ২০১৪

ফ্রি স্টাইলে রাস্তা পারাপারের দিন শেষ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ চোখের সামনে ফুটওভারব্রিজ কিংবা আন্ডারপাস। রাস্তা পারাপারের সময় অনেকেই এ সুবিধা কাজে লাগাতে চান না। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হাত উঁচিয়ে, গাড়ি থামিয়ে রাস্তা পার হতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন অনেকেই। আইনের প্রতি কারও যেমন তোয়াক্কা নেই। তেমনি নেই জীবনের মায়াও। শত-শত গাড়ির মাঝখান দিয়ে অবলীলায় রাস্তা পার হওয়ার দৃশ্য প্রতিদিনের। যেন কোন ভ্রƒক্ষেপ নেই। এখন থেকে তা চলবে না। যত্রতত্র রাস্তা পারাপারের দিন শেষ। ওভারব্রিজ কিংবা আন্ডারপাস ব্যবহার ছাড়া রাস্তা পার হলেই জেল জরিমানা। সামনে এসে দাঁড়াবে পুলিশ। আটক করার সঙ্গে সঙ্গে হাজির করা হবে ভ্রাম্যমাণ আদালতে। অপরাধের ধরন অনুযায়ী শাস্তি দেবেন বিচারক। পুলিশের পরিসংখ্যান বলছে, গেল পাঁচ বছরে রাস্তা পার হতে গিয়ে রাজধানীতে মারা গেছে সাড়ে ৯০০ মানুষ। চলতি বছর মারা গেছে ১৩৪ পথচারী। এই প্রেক্ষাপটে যত্রতত্র রাস্তা পারাপার ঠেকাতে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের পক্ষ থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান শুরু হয়েছে। টানা তিনদিন প্রচার অভিযানের পর নগরীতে আদালত বসানো হলো। অভিযানের সময় সচেতনতামূলক প্রচারপত্রও বিলি করা হয়। প্রথম দিনের অভিযানে ৩৩১ পথচারীকে ২৪ হাজার ৯৫ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এর মধ্যে বাংলা মোটরে ১৫৯ পথচারীকে ১৪ হাজার ১৬০ টাকা এবং কারওয়ান বাজার ক্রসিংয়ে ১৭২ জনকে ৯ হাজার ৯৩৫ টাকা জরিমানা করা হয়। ২০ টাকা থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করা হয় পথচারীদের। এই অপরাধে সর্বোচ্চ ছয় মাসের কারাদ-েরও বিধান রয়েছে। জরিমানা না দিতে পারায় পুলিশের প্রিজনভ্যানে অনেককেই ছয় ঘণ্টা আটকে রেখে শাস্তি দেয়া হয়। ছয় মাসের দ- হয় অনেকের। শাহবাগ থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত দুটি আদালত চারটি স্থানে পৃথক-পৃথকভাবে অভিযান চালায়। মোতায়েন করা হয় ২০০ শতাধিক অতিরিক্ত পুলিশ। মহিলা পথচারীদের পাকরাও করতে উপস্থিত রাখা হয় মহিলা পুলিশও। আগামী এক সপ্তাহ রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে এ অভিযান পরিচালনার কথা জানানো হয়েছে ডিএমপির পক্ষ থেকে। আইন অমান্য করার অপরাধে আটক করা হলেও বিশেষ ক্ষমা চাওয়া বা টাকা না থাকায় অনেককে ছেড়ে দেয়া হয়। ঢাকার রাস্তায় মানুষ কী পরিমাণ আইন অমান্য করে রাস্তায় চলে এর নজির দেখা গেল ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানের সময়। বাংলা মোটর মোড়ে যখন অভিযান চলছিল, তখন আদালতে হাজির করা আসামির দীর্ঘসারি। একজনের জরিমানার কাগজপত্র লিখতে লিখতে আসামি আনা হয় অন্তত ৫ জন। তাছাড়া উৎসুক মানুষের কমতি ছিল না সেখানে। ফুটপাথ কিংবা ওভারব্রিজে দাঁড়িয়ে শত-শত উৎসুক মানুষ অভিযান উপভোগ করেন। রূপসি বাংলা মোড়, বাংলা মোটর, কারওয়ান বাজারসহ ফার্মগেট এলাকায় প্রতিটি ওভারব্রিজ ও আন্ডারপাসের পাশে পুলিশের সতর্কবার্তা উল্লেখ করে সাইনবোর্ড ঝোলানো ছিল। অনেকেই এসবের তোয়াক্কা না করে রাস্তা পার হওয়ার চেষ্টা করেন। প্রতিদিন এভাবে রাস্তা পার হলেও মহিলা পথচারী ফরিদা (ছদ্মনাম) মঙ্গলবার মহিলা পুলিশের হাতে আটক হন। তাকে কেন ধরা হলো এ নিয়ে পুলিশকে শত প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে। যখন আদালতের সামনে এনে হাজির করা হলো- তখন নিজের ভুল বুঝতে পারলেন। তাতে কি। ঠিকই জরিমানা গুনতে হয়েছে। সতর্ক করে বলা হয়েছে-একই অভিযোগে আরেকদিন পুলিশের হাতে আটক হলে নিশ্চিত কারাদ- দেয়া হবে। রূপসি বাংলা মোড়েও বেশ কয়েকজনকে আটক করে মহিলা পুলিশ। তাদের মধ্যে একজন মিথিলা। একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন তিনি। সচেতন লোক হয়েও এমন অপরাধ করায় তাকে ৫০ টাকা জরিমানা গুনতে হয়েছে। বাংলা মোটর এলাকায় ফুটওভারব্রিজ রেখে প্রতিদিনের মতো রাস্তা পার হচ্ছিলেন ধানম-ির বাসিন্দা মোঃ কাদির। আজ যে তার বিধি বাম-তা জানা ছিল না। খেয়াল খুশি মতো রাস্তা পার হওয়ার সময় পাকরাও করে পুলিশ সদস্যরা। চোখ কপালে তাঁর। প্রশ্ন কী অপরাধ করেছি? কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই হাত ধরে টেনে নিয়ে আদালতের সামনে হাজির করা হয়। বলা হয় আইন মেনে রাস্তা পারপার না হওয়ার অপরাধে ১০০ টাকা জরিমানার কথা। কাদির মিয়া তখন বললেন, ‘আমি তো জানি না; উপর দিয়ে রাস্তা পার হতে হবে। ভবিষ্যতে আর হবে না বলে প্রতিশ্রুটি দেন তিনি। আদালত মানবিক দিক বিবেচনা করে তাকে ছেড়ে দেয়। কিন্তু ছাড়া পেলেন না একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আদালত বসার কারণে সবাই যখন ওভারব্রিজ ব্যবহারের চেষ্টা করছিল, তখন মিথুন যাচ্ছিল রাস্তার মাঝখান দিয়ে। তাকে ধরে এনে ১০০ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়। মঙ্গলবার সকালে রাজধানীর রূপসী বাংলা হোটেলের সামনে থেকে ফার্মগেট পুলিশবক্স পর্যন্ত এলাকায় দুটি ভ্রাম্যমাণ আদালত বসানোর কথা জানিয়েছেন মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মিলি বিশ্বাস। সকাল ১০টা থেকে দুই ঘণ্টায় কয়েক শ’ পথচারীকে জরিমানা করা হয়েছে। এর আগে রাজধানীতে ফুটওভারব্রিজ ও আন্ডারপাস ব্যবহারের বিষয়ে জনগণের মাঝে সচেতনতা তৈরি করতে টানা তিনদিন প্রচার চালায় পুলিশ। আগামি সাতদিন এসব এলাকায় ভ্রাম্যমাণ আদালত কাজ করবে বলে জানিয়েছেন তিনি। উপ-পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) খান মোহাম্মদ রেজওয়ান জানান, দুপুর ১২টা পর্যন্ত বাংলা মোটর ক্রসিংয়ে অসংখ্য পথচারীকে জরিমানা করা হয়েছে। কেউ জরিমানা না দিতে পারলে তাকে ছয় ঘণ্টা আটক রাখা হচ্ছে। ওই এলাকায় অন্তত পাঁচ পথচারীকে আটক করে রাখতে দেখা গেছে। ফুটওভারব্রিজ ব্যবহার না করে সড়কের মধ্য দিয়ে পারাপারের সর্বোচ্চ শাস্তি ছয় মাস কারাদ- অথবা ২০০ টাকা জরিমানা। ভ্রাম্যমাণ আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট সরওয়ার আলম বলেন, দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত সোনারগাঁও মোড়ে ৮৬ জনকে আর্থিক জরিমানা করা হয়েছে। এর মধ্যে জাকির নামের একজনকে ছয় মাসের কারাদ- দেয়া হয়েছে। আদালত বসার প্রথম দেড় ঘণ্টায় ৩৫ জনকে দ- দেয়ার কথা জানান তিনি। ডিএমপির চলমান এই অভিযানকে স্বাগত জানিয়েছেন বিশিষ্টজনরাও। এক প্রতিক্রিয়ায় নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের চেয়ারম্যান ও চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, মানুষ আইন মেনে চললে সড়ক দুর্ঘটনা অনেক কমে আসবে। আশাকরি সবাই আইন মেনে পথ চলবেন। নিজেদের মধ্যে অভ্যাস পরিবর্তন না করতে পারলে দুর্ঘটনা কমিয়ে আনা সম্ভব হবে না। তিনি চলমান এই অভিযান আগামী পাঁচ বছর একটানা পরিচালনা করার দাবি জানান। ওভারব্রিজ ও আন্ডারপাস ব্যবহারের আহ্বান জানিয়ে ২২ নবেম্বর থেকে ২৪ নবেম্বর পর্যন্ত মাইকে শাহবাগ থেকে কাওরান বাজারসহ নগরীরর বিভিন্ন এলাকায় প্রচার অভিযান চালানো হয় পুলিশের পক্ষ থেকে।
×