ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নাদিয়া মজুমদার

জেরুজালেম আরেকটি ‘ইনতিফাদা’ কি আসন্ন?

প্রকাশিত: ০৪:৫৩, ২৬ নভেম্বর ২০১৪

জেরুজালেম আরেকটি ‘ইনতিফাদা’ কি আসন্ন?

জেরুজালেমের অবস্থান পশ্চিম তীরে, ইসরাইলী দখলীকৃত এলাকায়। ১৮ নবেম্বর (২০১৪) পশ্চিম জেরুজালেমে অবস্থিত এক সিনাগগে ঢুকে প্রার্থনারত তিনজন আমেরিকান ও একজন ব্রিটিশ ইহুদী ধর্মযাজককে, যারা আবার ইসরাইলের নাগরিকও বটে, দুই তরুণ হত্যা করে। তারা ফিলিস্তিনী এবং ইসরাইলের নাগরিক। একজনের বয়স ২৭ বছর, আরেকজনের ২২ বছর। সম্পর্কে কাজিন, তারাও নিহত হয়। অর্থাৎ নিহতের সংখ্যা মোট ৬ জন। পশ্চিমের প্রধান মিডিয়া এই ঘটনাকে দুই ‘সন্ত্রাসী’র কুকা- বলেছে, মধ্যপ্রাচ্যের যেসব মিডিয়া নিরপেক্ষতা বজায় রাখার পক্ষপাতী, যেমন : আল-মনিটর, দুই তরুণকে দুষ্কৃতকারী বলে পরিচয় দেয়। তবে সিনাগগে অন্য প্রার্থনারতদের মধ্য থেকে কেবলমাত্র চার ধর্মযাজককে হত্যা করার পেছনে কোন ঐশ্বরিক কারণ কি রয়েছে? এই সিনাগগ ঘটনার আগের দিন, ১৭ নবেম্বর ইসরাইলী বসতি স্থাপনকারীরা পূর্ব জেরুজালেমে এক ফিলিস্তিনী বাস ড্রাইভারকে শ্বাসরুদ্ধ করে মেরে ফেলে। ইসরাইলী মিডিয়া এই ঘটনাকে আত্মহত্যা বলে প্রচার করে। অন্যান্য মিডিয়ার মতো বিবিসি হত্যাকা-টি বেমালুম চেপে যায়। তবে যেহেতু সিনাগগ ঘটনা হামাসের আশীর্বাদ পায়, বিবিসি নিহত দুই তরুণের প্রসঙ্গ রেফারেন্স হিসেবে বলতে বাধ্য হয় বা সহিংস বসতি স্থাপনকারীরা ১২ নবেম্বর রামাল্লাহ্র উত্তর-পূর্বাংশে অবস্থিত আল-মুগায়ির গ্রামের এক মসজিদে আগুন লাগায়। ইউরো-আটলান্টিকের মিডিয়া এই খবরটিও চেপে যায়। কিন্তু সিনাগগ ঘটনার কারণ অবশ্য ফিলিস্তিনী বাস ড্রাইভারকে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যার জন্য হয়নি। এর ক্ষেত্র আসলে গত কয়েকমাস ধরেই তৈরি হচ্ছিল। দুর্ভাগ্যবশত, অভ্যাসমাফিক পশ্চিমের মিডিয়া সেসব প্রবহমান ঘটনা পরিবেশন করেনি বা শব্দের অপব্যবহারের কারণে ফিলিস্তিনীরা দুর্বৃত্ত, সন্ত্রাসী পরিচিতি পায়, অপরদিকে ইসরাইলী জীবনহানি পরিবেশনে ব্যবহার হচ্ছে ও হয় নির্বাচিত ভাষাÑ ‘খুন বা মার্ডার, নৃশংসতা বা এ্যাট্রসিটি, বিনা বিচারে প্রাণদ- বা লিনচিং, হিংস্র, নৃশংস বা স্যভিজ, ঠা-া মাথায় খুন’ ইত্যাদি। অবশ্য যেহেতু ‘ইসরাইলের সমালোচনা = এন্টি সেমেটিজম’ বলা হয় এবং ফিলিস্তিনীরাও সেমেটিক, কিন্তু ভয়ভীতির কারণে মিডিয়া ইসরাইল-ফিলিস্তিন কেইসে ‘উৎপীড়ক ও ভিকটিমের ভূমিকা’ পাল্টে দিয়ে এদিক-ওদিক করেছে। এই মধ্যপ্রাচ্য সঙ্কটের আসল শিকড় যে কোথায় বা ফিলিস্তিনীরা যে আসলে ‘অবৈধ সামরিক জবরদখলের ভিকটিম’, কেন ‘জবরদখলকৃত ভূখ-’, ‘অবৈধ বসতি স্থাপন’ বলা হচ্ছে ইত্যাদি আইডিয়া বা ধারণা, কেবলমাত্র টিভি সংবাদনির্ভর হলে বোঝা একেবারেই অসম্ভব। ফলে ব্যারোনেস সাঈদি ওয়ার্সির জন্য সিনাগগ ঘটনার কভারেজ ছিল ধৈর্যের শেষ খড়কুটা। (ব্যারনেস যুক্তরাজ্যের বৈদেশিক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ছিলেন, জুলাই মাসে গাজায় পরিচালিত ‘অপারেশন প্রটেকটিভ এজ’-এর বিরুদ্ধে ডেভিড ক্যামেরনের নির্বিকার ভূমিকার তীব্র সমালোচনা তো করেনই, পদত্যাগও করেন)। এই পরিপ্রেক্ষিতেই ব্যারোনেস ওয়ার্সি টুইটে ‘সিনাগগ হত্যাকা-কে আল-আকসা মসজিদে সংঘটিত সহিংসতা ও প্রতিবাদের সমকক্ষ’ বলেন। ফলে সূচনা হয় টুইট যুদ্ধের। আরেক টুইটে ব্যারোনেস প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন ও বিরোধী নেতা মিলিব্যান্ডকে আহ্বান করেন যে, ‘এক ফিলিস্তিনীর জীবন=এক ইসরাইলীর জীবন এবং হত্যাকা-ের জন্য উভয়পক্ষেরই নিন্দা করি, সঙ্গে জবরদখলীরও’। ব্যারোনেসের প্রস্তাবে গররাজির দল টুইট যুদ্ধে নেমেছে। এই টুইট যুদ্ধ অব্যাহত রয়েছে। সাম্প্রতিক ঘটনায় প্রবেশের আগে অতি দ্রুত পূর্ব জেরুজালেমের বা ওল্ড সিটির ইতিহাস ঝালাই করে নেয়া যাক। দেয়ালঘেরা দশমিক নয় বর্গকিলোমিটার আয়তনের এক চিলতে জমি নিয়ে গড়ে ওঠা ওল্ড সিটি পূর্ব জেরুজালেমে অবস্থিত। আল-আকসা মসজিদ ওল্ড সিটির টেম্পল মাউন্টের ‘দ্বিতীয় টেম্পলে’ অবস্থিত। ইহুদী ঐতিহ্য ও ধর্মগ্রন্থ অনুযায়ী খ্রিস্টপূর্ব ৯৫৭ অব্দে রাজা দাউদের ছেলে রাজা সোলায়মান ‘প্রথম টেম্পল’ নির্মাণ করেন। কিন্তু খ্রিস্টপূর্ব ৫৮৬ অব্দে ব্যাবিলনীয়রা ধ্বংস করে দেয়। খ্রিস্টর্পূব ৫১৬ অব্দে ধ্বংসস্তূপের ওপরে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘দ্বিতীয় টেম্পল’, কিন্তু কয়েকশ’ বছর পরে, ৭০ খ্রিস্টাব্দে রোমকদের হাতে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় আবার। পরবর্তী প্রায় ছয়শ’ বছর ‘টেম্পল’ সাইট অনাদরে পড়ে থাকে। দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমরের (রা.) শাসনামলে ’টেম্পল’ সাইট থেকে বেশ খানিকটা দক্ষিণে মক্কামুখী করে প্রথম কাঠের আল-আকসা মসজিদ নির্মিত হয়। পরবর্তীকালে বিভিন্ন সময় মসজিদের নির্মাণকর্ম অব্যাহত থাকে এবং ৬৯২ সালে গম্বুজটি সম্পন্ন হয়। এই মাউন্ট সাইট ও পশ্চিমের দেয়াল ইহুদীদের মহাপবিত্র স্থান এবং তাদের ঐতিহ্যগত ধারণা যে, তৃতীয় ও চূড়ান্ত টেম্পল নির্মাণ হতে হবে। ইহুদীরা মাউন্টমুখী হয়ে প্রার্থনা করে থাকে। যেসব স্থানে ঈশ্বরের ঐশ্বরিক উপস্থিতির স্পষ্টত প্রকাশ রয়েছে, টেম্পল সাইট তাদেরই একটি। তবে টেম্পল মাউন্টে যে ‘প্রথম টেম্পল’ ছিল এমন প্রমাণাদি এখনও পাওয়া যায়নি। মুসলমানদের কাছে আল-আকসা মসজিদ ও কুবাস আস-সাখরা বা ডোম অব দি রক পবিত্র বলে গণ্য হয়ে আসছে। কাবামুখী কিবলা হওয়ার পূর্বে জেরুজালেম ছিল কিবলা। হযরত মোহাম্মদের (সা.) মেরাজ সফর সম্পন্ন হয় জেরুজালেমের এই লোকেশন থেকে। আল-আকসা লোকেশন মুসলমানদের কাছে তৃতীয় পবিত্রতম স্থান বলে পরিগণিত হয়ে আসছে। আল-আকসার প্রবেশপথ ও কমপ্লেক্স সর্বক্ষণ ইসরাইলী প্রহরাধীন। অমুসলমানরা মসজিদ কমপ্লেক্সে প্রবেশ করে থাকে ইসরাইলী পুলিশের তত্ত্বাবধানে ও নিয়ন্ত্রণে, তবে ইহুদীদের জন্য মসজিদের ভেতরে প্রবেশ বা প্রার্থনা নিষিদ্ধ। অবশ্য ইহুদী বিশ্বাস মতে মহাপবিত্র মাউন্টে ঐশ্বরিক উপস্থিতির কারণে ইহুদীমাত্রই অনিচ্ছাকৃত প্রবেশ পরিহার করবে। কারণ, প্রবেশকারীকে হতে হবে যথার্থ নির্মল পবিত্র (অর্থাৎ, শিশু ছাড়া আর কে যথার্থ নির্মল পবিত্র হতে পারে!)। প্রাচ্য-খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের জন্যও পবিত্র স্থান, চার্চ অব রিজারেকশন এখানে রয়েছে। ১৯৬৭ সালের ছয়দিনের যুদ্ধের পর থেকে ‘ওল্ড সিটি’সহ পূর্ব জেরুজালেম, পশ্চিম তীর এবং গাজা ইসরাইলী দখলে চলে যায়, তবে আল-আকসার প্রশাসন ১১৮৭ সাল থেকে প্রবর্তিত ওয়াক্ফ সিস্টেমের অধীনেই থেকে যায়। বর্তমানে পাঁচ লাখেরও অধিক ইহুদী অভিবাসী বসতি স্থাপন করে এবং কমসে কম একশ’টি অবৈধ আউটপোস্টও গড়ে ওঠে। যেমন : তেল-আবিব ও জেরুজালেমের মধ্যবর্তী স্থানে অবৈধভাবে নির্মিত বসতিতে ৫৫০০০ অভিবাসী বাস করছে। অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি সময়ে ইসরাইলী নেসেট (পার্লামেন্ট) প্রস্তাব আনে যে, আল-আকসা ইহুদীদের প্রার্থনার জন্যও খুলে দেয়া হোক এবং দুই ধর্মাবলম্বীর জন্য মসজিদে প্রবেশ সময়ও বেঁধে দেয়া হবে। এবং বলা হয়, যেখানে ইহুদীর প্রবেশাধিকার নেই, সেখানে মুসলিম প্রবেশাধিকারও থাকতে পারে না। এই প্রস্তাবের মধ্যে স্ট্যাটাস-ক্যুও ভঙ্গের ইঙ্গিত সুস্পষ্ট। ফলে প্রতিবাদমুখর ফিলিস্তিনীদের ৪০০ জনের একটি দল আল-আকসার সামনে ব্যারিকেড তৈরি করে। এই ব্যারিকেডকে কেন্দ্র করে গোলমাল জমে উঠতে থাকে। ফিলিস্তিনীদের চিরায়ত পাথরবাজি তথা ছোড়াছুড়ির পুলিশী উত্তর হিসেবে ব্যবহার হয় গ্রেনেড, রাবারের গুলি, আসল গুলি ইত্যাদি, হতাহত ও মৃত্যুও ঘটে। পুলিশের সঙ্গে বসতি স্থাপনকারীরাও যোগ দেয়। এই বসতি স্থাপনকারীরা আগ্নেয়াস্ত্র রাখার অধিকারী। গ-গোলের এক পর্যায়ে, ১৯৬৩ সালের পরে, ২০১৪ সালের ৩০ অক্টোবর, ইসইরালী প্রশাসন আল-আকসা মসজিদে আবার তালা ঝুলিয়ে দেয়। পরিস্থিতি আরও ঘনীভূত হয়ে ওঠে। তাই দেড়দিন বাদে প্রথমে কেবলমাত্র পঞ্চাশোর্ধদের জন্য এবং পরে সব বয়সী ফিলিস্তিনী নামাজ আদায়কারীদের জন্য তালা খুলে দেয়া হয়। তাতে পরিস্থিতির খুব একটা পরিবর্তন ঘটে না। যেমন, হেবরনে ২১ বছর বয়সী ফিলিস্তিন ইসরাইলী সেনার গুলিতে নিহত হয় বা জেরুজালেমে এবং ওল্ড সিটিতে ফিলিস্তিনীদের পাথরআক্রমণ ও ফায়ার ক্র্যাকের জবাবে একই সপ্তাহের মধ্যে দ্বিতীয় দফায় আল-আকসার প্রবেশদ্বারে তালা পড়ে। ইসরাইলী পার্লামেন্টারীয় পদক্ষেপ থেকে সুস্পষ্ট যে, ইসরাইল আল-আকসা কমপ্লেক্সের ওপরে নিয়ন্ত্রণ ও সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে স্ট্যাটাস-ক্যুও ভেঙ্গে দিতে চাইছে। ইসরাইলী এই প্রচেষ্টার মধ্যে, মোহাম্মদ আব্বাসের বক্তব্য অনুযায়ী, ‘ফিলিস্তিন-ইসরাইল বিদ্বেষ চিরায়ত রাজনৈতিক, কখনোই ধর্মীয় নয়। স্ট্যাটাস-ক্যুও বাতিল করলে বিশ্বকে ধর্মযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়া হবে।’ যে পরিবেশগত পরিপ্রেক্ষিত পূর্ববর্তী দুটো ইনতিফাদা সম্ভব করে, জেরুজালেমের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি প্রায় সেই পরিপ্রেক্ষিতের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে। তৃতীয় ইনতিফাদা ঠেকাতে হলে সব পক্ষকেই দ্রুত, অতিদ্রুত সক্রিয় হতেই হবে।
×