ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

নবাব সিরাজ

প্রকাশিত: ০৩:৪৩, ২৫ নভেম্বর ২০১৪

নবাব সিরাজ

হিজরি ১১৬৯ সালের ১০ রজব মোতাবেক ইংরেজি ১৭৫৬ সালের ৯ এপ্রিল নবাব আলীবর্দী খাঁর মৃত্যুর পর সিরাজ বাংলার সিংহাসনে বসেন। মৃত নবাবের কন্যা ঘসেটি বেগম তাঁর পিতার জীবদ্দশায় বাংলার দিওয়ানির উপর প্রভুত্ব বিস্তার করেন। কিন্তু তিনি তাঁর নিজ বোনের ছেলে সিরাজকে অধিকতর ভয় করতেন। আর এজন্য বসবাসরত প্রাসাদ মতিঝিল মহলের চারদিকে ঘসেটি বেগম পরিখা কেটে সিরাজের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধের জন্য তৈরি হতে থাকেন। কিন্তু নবাব সিরাজের সঙ্গে ঘসেটি বেগমের এ ধরনের নানা ঘৃণিত আচরণে মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে বিশেষ কূটনীতির অধিকারী নবাব সিরাজ উদ-দৌলার পক্ষাবলম্বন করে। কিন্তু তারপরও ঘসেটি বিবি তাঁর অতি ঘনিষ্ঠ ও প্রিয় বন্ধু এবং পূর্ণ সমর্থক রাজা রাজবল্লভ ও তাঁর পুত্র কৃষ্ণবল্লভের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকেন। নবাব সিরাজকে নিয়ে বহু কাল্পনিক কিচ্ছা-কাহিনী রয়েছে এবং বহু নাট্যকার নাটক মঞ্চস্থ করেছেন। ইতিহাস কতো নির্মম এবং ইতিহাসের রচয়িতারাও কতো নির্দয় ও পাষাণ। যেসব নিমকহারাম সিরাজকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করেছে অথবা তাঁর হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছে, এমনকি তাঁকে হত্যা করেছে; ইতিহাসবিদরা সেসব নিমকহারামের ব্যাপারে নীরবতা পালন করেছেন, চুপ থেকেছেন। সিরাজ আমাদের এ দেশের মাটি ও মানুষের সন্তান ছিলেন এবং তিনি দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সুরক্ষার জন্য পাঁচটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। নবাব সিরাজকে তাঁর দুর্যোগপূর্ণ রাজত্বকালের পুরো এক বছর তিন মাসই নানা ষড়যন্ত্রের মোকাবেলা করতে হয়েছিল। আর এজন্য নাকি গোটা সমাজের নৈতিক মেরুদ- ভেঙ্গে পড়েছিল। ইংরেজ সেনাপতি ক্লাইভ যখন নৌবহর নিয়ে ভাগীরথীর উপর দিয়ে পলাশী প্রান্তরে নবাব সিরাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে যাচ্ছিলেন, তখন পলতা নামক জায়গার ওই সময়ের বিখ্যাত অলি শাহ্ যোবায়েরের (রহ.) কাছে বিজয় লাভের জন্য দোয়াপ্রার্থী হন এবং শাহ্্ সাহেবও তাঁর জন্য দোয়া করেন। উপস্থিত মুসলমানরা তা দেখে হায় হায় করে উঠলেন এবং এরূপ করার কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। উত্তরে শাহ্ সাহেব বললেন, দোয়া না করে কী করব? দেখলাম, খিজির (আ.) ক্লাইভের নৌবহরের আগে আগে পতাকা ধারণ করে যাচ্ছেন। মুসলমানদের নবাব সিরাজ হিজরি ১১৭১ সালের শাওয়াল মাসের ৫ তারিখ ভোরে পলাশীতে উপস্থিত হয়ে গোলা-বারুদের যুদ্ধ শুরু“ করে দেন। এ যুদ্ধে বিপক্ষ দল ইংরেজের সৈন্যসংখ্যা মাত্র দুই হাজার এবং সিরাজ উদ-দৌলার সৈন্যসংখ্যা ছিল প্রায় দশ হাজার। যুদ্ধের এক পর্যায়ে নবাবের বিশ্বস্ত সেনাপতি মীর মদন ইংরেজের হাতে নিহত হলে নবাব তাঁর প্রধান সেনাপতি মীর জাফরকে যুদ্ধে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে বার বার অনুরোধ করেও ব্যর্থ হন, তিরস্কৃত হন। অবশেষে ওই বছরেরই শাওয়ালের ৭ তারিখ রাতের প্রথমভাগে ভগবানগোলার উদ্দেশে পলায়নের পর মীর জাফর সিরাজের প্রাসাদে ঢুকে বাংলার মসনদে আরোহণ করেছিলেন। দুর্ভাগ্য, সিরাজ পরদিন আজিমাবাদের পথে অগ্রসর হলে রাজমহল পৌঁছার পর সামান্য পানির কারণে তাঁর নৌকা চড়ায় ঠেকে যায়। এরই কাছে বসবাসকারী দরবেশ শাহ্দান বা দানশাহ্ পীরজাদার কাছে নবাব সিরাজ একটি ছোট নৌকা প্রার্থনা করলে তিনি নবাবের আহারের ব্যবস্থায় নিজেকে ব্যস্ত দেখালেও সিরাজকে সাহায্য না করে গোপনে মীর দাউদের কাছে এ বার্তা প্রেরণ করেন। তারপর দাউদ এসে নবাবকে বন্দী করে একদল রক্ষীসহ মুর্শিদাবাদে প্রেরণ করেন। এরপর মীর কাসেম নবাবকে মুর্শিদাবাদে নিয়ে গেলে মীর জাফর তাঁকে কারারুদ্ধ করেছিলেন। পরদিন ইংরেজ প্রধানদের পরামর্শে এবং জগৎশেঠের জেদাজেদিতে তিনি তাঁকে হত্যা করেন। পরে তাঁর নানা নবাব আলীবর্দী খানের সমাধিসৌধ খোশবাগে তাঁর লাশ দাফন করা হয়। এর কিছুদিন পর নবাব সিরাজের ছোট ভাই মীর্জা মেহেদি আলীকেও হত্যা করে এবং নবাবের পাশেই তাঁর মরদেহ কবরস্থ করা হয় (রিয়াজ-উস-সালাতিন)। আর নবাব সিরাজের স্ত্রী লুৎফুন্নেসা খোশবাগে তাঁর স্বামী সিরাজের কবরের পাশে একটা কুঁড়েঘর বানিয়ে বাকি জীবনটা সেখানেই অতিবাহিত করে দেন। স্ত্রী লুৎফা দীর্ঘ ২৮ বছর পর ইংরেজি ১৭৯০ সালের নবেম্বর মাসে ইন্তেকাল করলে তাঁকে তাঁর পরলোকগত স্বামী সিরাজের পদতলে সমাহিত করা হয়েছিল। বহিরাগত! বহিরাগত নিয়ে কথা। বহিরাগত অর্থাৎ যাঁরা বাইরে থেকে এসেছেন। বলা হয়ে থাকে, ভারতবর্ষে সবাই বহিরাগত। কথাটাকে ঘুরিয়েও বলা যায় এভাবে বহিরাগতরাই ভারতবাসী। রবীন্দ্রনাথ ভাবালুতার সঙ্গে যে দাবি পেশ করেছেন, ইতিহাসের পৃষ্ঠায় তার নানা সাক্ষ্য ছড়িয়ে আছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ‘বহিরাগত’দের ঢেউয়ের পর ঢেউ ভারতবর্ষকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। অতিথি হিসেবে যাঁরা এসেছেন, তাঁরা স্থিত হয়ে বসেছেন, তাঁদের ভারতীয় সত্তা গভীরে প্রোথিত হয়েছে। কিছুকাল বাদে ফের নবীন অতিথিবৃন্দের আগমন, হয়ত প্রাথমিক পর্যায়ে কিছু বিসংবাদ-সংঘাত-ভুল বোঝাবুঝি, তবে সেসবও ক্রমে থিতিয়ে গেছে। দেশের এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলেও এমনতর জনপুনর্বিন্যাস লক্ষ্য করা গেছে। সম্প্রতি ‘বহিরাগত’ শব্দটি হঠাৎ বিশ্ববিদ্যালয় প্রসঙ্গে কিছুটা আলোচনার সৃষ্টি করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বের সমস্ত চিন্তার-ভাবনার-প্রশ্নের-উৎকণ্ঠার বিনিময় ক্ষেত্র। যে কোন সমস্যা নিয়ে যে কেউই এখানে জড়ো হতে পারেন। বাধাবন্ধনহীন তর্ক আলোচনার ঝড় বইবে বিশ্ববিদ্যালয়ে। কোন চিন্তাই বহিরাগত নয়, চিন্তার বাহকরাও অবশ্যই বাইরের কেউ নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে পোশাকী অর্থে যুক্ত না থাকলেও প্রাঙ্গণে প্রবেশে তার অধিকার কোন ফরমান কেড়ে নিতে পারে না। এখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভিজ্ঞতার উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। গত শতকের তিরিশের দশক থেকে শুরু করে ইউরোপ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে বিদ্বজ্জন, সঙ্গীতজ্ঞ, শিল্পী, চলচ্চিত্রকার ইত্যাদি নানা ধরনের গুণী ব্যক্তি মার্কিন দেশে আশ্রয়প্রার্থী হয়েছেন। তাঁদের সাদরে বরণ করে নেয়া হয়েছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি চর্চায় দশকের পর দশক ধরে মার্কিন দেশ যে অন্য সমস্ত দেশকে ছাড়িয়ে গেছে, তার মস্ত বড় কারণ ‘বহিরাগত’দের নিবিড় গবেষণা। পারমাণবিক গবেষণা থেকে শুরু করে সব ধরনের বৈজ্ঞানিক প্রয়াসে সদ্য আগত বৈজ্ঞানিকরা তাঁদের প্রতিভা যুক্ত করেছেন, মার্কিন প্রযুক্তি ক্রমশ উন্নত থেকে উন্নততর হয়েছে। মধ্য ইউরোপ থেকে আগত এক ঝাঁক ইহুদী ধনকুবের তাঁদের কূটকৌশল প্রয়োগ করে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর মার্কিন অর্থব্যবস্থাকে চাঙ্গা রাখতে সমর্থ হয়েছেন। ধ্রুপদী সঙ্গীত চর্চায় যেমন জোয়ার এসেছে, আধুনিক যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নতুন সঙ্গীত রচনার ক্ষেত্রেও দ্বিতীয় প্রজন্মের বহিরাগতদের প্রতিভার একচ্ছত্র বিকিরণ। বহিরাগতদের পাল্লা ভারি হয়েছে। আমাদের দেশে ইদানীং বহিরাগত ও অনুপ্রবেশকারীদের নিয়ে নানা আলোচনা হচ্ছেÑ হচ্ছে সমালোচনাও। কেউ কেউ বহিরাগতদের ক্ষমাঘেন্না করে অনুপ্রবেশকারীদের প্রসঙ্গে সোচ্চার হয়ে ওঠেন। বহিরাগত নিয়ে কথা উঠলে ভারত-বাংলাদেশের প্রসঙ্গ এসে যায়। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্ত জড়িয়ে আছে। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান থেকে বিনা অনুমতিতে হাজার-লক্ষ শরণার্থী ভারতে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করেছিলেন। এ সময় তাঁদের কিন্তু কেউ অনুপ্রবেশকারী বলে চিহ্নিত করত না। বলা হতো, তাঁরা উদ্বাস্তু। বোঝা মুশকিল, উদ্বাস্তুরা কবে থেকে অনুপ্রবেশকারীতে রূপান্তরিত হলো। দেশ ভাগ হওয়ার সময় ভারত সরকারের পক্ষ থেকে উদাত্ত ঘোষণা করা হয়েছিল : যেসব একদা-ভারতীয় নাগরিক পাকিস্তানে সম্ভ্রম বজায় রেখে স্বাচ্ছন্দ্যে জীবিকা অর্জনে অসমর্থ হবেন, তাঁদের সব সময় ভারতে প্রবেশ করবার ও স্থায়ীভাবে বসবাস করবার অধিকার থাকবে। সেই ঘোষণায় কোন সময়সীমা নির্দিষ্ট ছিল না এবং তা আজও পর্যন্ত প্রত্যাহৃতও হয়নি। তাই বলে হঠাৎ ফতোয়া জারি করে কাউকে বহিরাগত কিংবা অনুপ্রবেশকারী বলে বর্ণনা করা অনৈতিক ও অন্যায়। যেভাবেই হোক যদি বাংলাদেশের কোন নাগরিক সেখানে অস্বস্তি কিংবা অসুবিধা বোধ করে ভারতে চলে আসতে চান, তাঁর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি কোন অর্থেই সমর্থনযোগ্য নয়। স্মর্তব্য, সীমান্তবর্তী দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশের সঙ্গেই ভারত সরকারের রয়েছে বন্ধুত্বমূলক প্রগাঢ় সম্পর্ক। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি সহজ হবে। প্রখ্যাত আইনজীবী যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত (যাঁর স্মরণে দেশপ্রিয় পার্কের নামকরণ) এবং তাঁর স্ত্রী নেলী সেনগুপ্ত একদা জাতীয় কংগ্রেসের সাময়িক সভানেত্রী ছিলেন। উনারা দু’জনেই ছিলেন চট্টগ্রামের মানুষ। সূর্য সেন, কল্পনা দত্তও তাই। এমনকি ওড়িশ্যার জননায়ক বিজু পট্টনায়কের মামাবাড়িও চট্টগ্রাম। এক বাঙালী ব্রাহ্ম পরিবার। ধরুন, এই পরিবারের অতি নিকটাত্মীয়দের কোন বংশধর এত দিন চট্টগ্রামে নিশ্চিন্তে বসবাস করছিলেন, এখন তিনি পরিণত বার্ধক্যে উপনীত, তাঁকে দেখাশোনা করবার কেউ নেই, এমন অবস্থায় তিনি যদি কলকাতায় চলে এসে কোন কাছের আত্মজনের বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করেন, তাঁকে কি বহিরাগত কিংবা অনুপ্রবেশকারী বলে ঘোষণা করে ফের বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হবে? বহিরাগত নিয়ে অনেক কথা হলো। পরিশেষে একটি লঘু কাহিনী টেনে এনে লেখাটির ইতি টানছি। গত শতকের তিরিশের দশকের গোড়ার দিককার কথা। ঢাকায় জনৈকা ধ্রুপদী সঙ্গীতে পারদর্শিণী রূপবতী কিশোরী অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি বিখ্যাত এক কবিকে বিয়ে করেন। এক সময় তিনি নিজেও কথাসাহিত্যিক হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ দিলীপকুমার রায় ও কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন অন্তরঙ্গ বন্ধু। এই দুই বন্ধুই মাঝেমধ্যে ঢাকায় গেলে কিশোরীটিকে তাঁর বাড়িতে গিয়ে সমাদর করে গান শিখিয়ে আসতেন। এদিকে সময়ে-অসময়ে কিশোরীর বাড়িতে এমন সঙ্গীতজ্ঞদের আগমনকে পাড়ার বেকার যুবকরা পছন্দ করতেন না। তারা এই বহিরাগত এই অনুপ্রবেশকারীদ্বয়কে সমুচিত শিক্ষা দিতে বদ্ধপরিকর। এক দিন সন্ধ্যাবেলায় কাজী নজরুল শৌখিন ধুতি-পাঞ্জাবি-চাদরে সুসজ্জিত হয়ে কিশোরীটির পিতৃগৃহের দোরগোড়ায় ভাড়া করা ঘোড়ার গাড়ি থেকে অবতরণ করলেন। নজরুল ঘোড়ার গাড়ি থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে কয়েকটি বখাটে যুবক ঝাঁপিয়ে পড়ে নজরুলকে উত্তম-মধ্যম দিতে শুরু করল। নজরুল তখন বেকায়দায় পড়ে কাতরোক্তি করেছিলেন : ‘ওরে তোরা ভুল করছিস! আমি দিলীপ নই, আমি নজরুল!’ বেকার ছেলের দল মোটেই ভুল করেনি। তাদের বিচারে দিলীপ কুমার এবং কাজী নজরুল দু’জনেই ছিলেন বহিরাগত। অনুপ্রবেশকারী! আনন্দবাজার পত্রিকায় অশোক মিত্র’র লেখা সংক্ষিপ্তাকারে প্রকাশ করা হল
×