ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

দাসত্ব আজও টিকে আছে

প্রকাশিত: ০৩:৪৩, ২৫ নভেম্বর ২০১৪

দাসত্ব আজও টিকে আছে

গত ১৮ অক্টোবর পালিত হয়েছে জাতিসংঘ দাসত্ববিরোধী দিবস। বিশ্বের বুক থেকে দাসত্বের আনুষ্ঠানিক বিলুপ্তি ঘটেছে বটে, তথাপি মৌরিতানিয়া ও সুদানের মতো আরব-আফ্রিকান রাষ্ট্রগুলোতে তা বিভিন্ন ছদ্মবেশে টিকে আছে। আল আহরাম উইকলির সম্পাদক গামাল নক্রুমা সম্প্রতি তাঁর পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে জানিয়েছেন, মৌরিতানিয়ার ৩৫ লাখ মানুষের ২০ শতাংশই কার্যত দাসত্বের মধ্যে বসবাস করে। দেশটি বাহ্যত অতীতের মধ্যে আটকা পড়ে আছে। মৌরিতানিয়া হলো আনুষ্ঠানিকভাবে দাসত্ব বিলোপকারী সর্বশেষ দেশ। তারপরও সে দেশে দাসত্ব বিরাজ করছে এবং কিছু সংগঠন এই দাসপ্রথার বিরুদ্ধে নিষ্ঠার সঙ্গে সংগ্রাম করে চলেছে। ওদিকে পাঁচ বছর ধরে থেমে থেমে গৃহযুদ্ধ চলার পর একদা আফ্রিকার বৃহত্তম দেশ সুদান দুই অংশে বিভক্ত হয়ে গেছে। বর্ণবাদ, ধর্মান্ধতা ও গণতন্ত্রের অনুপস্থিতিতে দেশটির উভয় অংশেই লড়াইয়ে বাস্তুচ্যুত ও পরবর্তী পর্যায়ে দাসত্ববন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে অগণিত মানুষ। নুবা পার্বত্যাঞ্চল, দক্ষিণ কোরদোফান প্রদেশ, ব্লু নাইল প্রদেশ এবং বিরোধীয় তেলসমৃদ্ধ আবাসি ছিটমহলের অনেক অ-আরব বা আরবায়িত নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর বহু সদস্যকে ধরে দাস হিসেবে সুদানের রাজধানী খার্তুমে এবং অন্যান্য বড় নগর কেন্দ্রে প্রাদেশিক রাজধানীতে নিয়ে আসা হয়েছে। বর্তমানে পরিত্যক্ত লোহিত সাগর তীরবর্তী বন্দর সুয়াকিন ছিল আজকের দক্ষিণ সুদান ও কোরদোফান থেকে জাহাজযোগে লোহিত সাগর হয়ে আরব উপদ্বীপে দাস রফতানির বন্দর। হাল আমলে মিসর হয়ে ইসরাইলে ও ভূমধ্যসাগরীয় দেশগুলোতে এমনকি ইউরোপেও মানবপাচার এক জমজমাট ব্যবসায় পরিণত হয়েছে যা মধ্যযুগের দাস ব্যবসার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। নক্রুমা এ প্রসঙ্গে বিরোধী দল উম্মা পার্টির নেতা সাদিক আল-মাহদীর সঙ্গে কথা বলেছেন। তাঁর ধারণা জানতে চেয়েছেন। তিনিও দাসপ্রথার অস্তিত্ব স্বীকার করে বলেছেন, ‘আমরা আফ্রিকা মহাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমরা আফ্রিকার মানুষ। সাংস্কৃতির দিক দিয়ে আমরা মূলত আরব, ধর্মমতের দিক দিয়ে মুসলমান। খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। এই দেশে দাস প্রথার প্রচলন ছিল এবং এখনও দেশের প্রত্যন্ত কোন কোন এলাকায় এই প্রথার চল এখনও হয়ত রয়ে গেছে। তথাপি আমরা দাসপ্রথা সমর্থন করি না বরং প্রবলভাবে বিরোধিতা করি।’ মাহদী বলেন, সুদানের চলমান গৃহযুদ্ধ দাসপ্রথার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। সুদানের জনগণের শোচনীয় অর্থনৈতিক অবস্থার কারণেই মানুষ কার্যত বেগার খাটতে বাধ্য হচ্ছে। আল-মাহদী ঈষৎ ব্যাখ্যা করে বলেন, গণতন্ত্র না থাকার কারণেও সুদানের মানুষ দাসত্ববন্ধনে আবদ্ধ হয়। দাসত্ব নানা ধরনের রূপ পরিগ্রহ করতে পারে। কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরাচারী সরকারগুলো জনগণকে দাসত্ববন্ধনে রেখে দেয় এবং এটাই হলো আজকের সুনাদের দুঃখজনক পরিস্থিতি। সুদানে আজ প্রকাশ্যে দাসদের নিলামে কেনাবেচা করা হয় না। দাস হিসেবে কাউকে চিহ্নিতও করা হয় না। তথাপি বেআইনী অস্ত্র ও সশস্ত্র মিলিশিয়াদের বিস্তার, অর্থনৈতিক স্থবিরতা, লাগামহীন বেকারত্ব এবং ব্যাপক দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি দারিদ্র্যক্লিষ্ট মানুষদের ক্রীতদাসে পরিণত হওয়ার অনুকূল অবস্থা তৈরি করেছে। জাতিসংঘের রিপোর্ট অনুযায়ী, নুবা জনগোষ্ঠীর আড়াই লাখ লোকসহ বাস্তুচ্যুত সুদানীদের সরকারী ‘শান্তি শিবিরে’ জোর করে ঠেলে দেয়া হচ্ছে এবং সেখানে তারা অন্তরীণ থাকছে। জাতিসংঘের ওই রিপোর্টে এই অমানবিক সমস্যাটিকে আরও বিশদরূপে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ওতে বলা হয় যে, ঊনবিংশ শতাব্দীতে সুদানে মাহদীদের শাসন চলাকালে আরব দাস-ব্যবসায়ীদের হাতে হাজার হাজার অ-আরব ক্রীতদাস থাকত। তারা আরও হাজার হাজার ক্রীতদাসকে মিসর ও আরব বিশ্বে রফতানি করত। আল-মাহদীর সমালোচকদের অভিযোগ, ১৯৮৬ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে তাঁর প্রতিরক্ষামন্ত্রী সুদান পিপলস লিবারেশন আর্মির (এসপিএলএ) বিরুদ্ধে এক নিরাপত্তা বেষ্টনী গড়ে তোলেন। আল-মাহদীর নির্দেশে এরপর আরব জাতিতে রূপান্তরিত বাগারা সম্প্রদায়ের মিলিশিয়াদের অস্ত্রসজ্জিত করা হয়। এরা অতঃপর দিনকা জনগোষ্ঠীর কৃষকদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস চালাতে থাকে। সুদানে নিযুক্ত জাতিসংঘ মানবাধিকার র‌্যাপোর্টিয়ার গ্যাসপার বিরো ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জানান, ‘দাসত্ব, দাস-ব্যবসা ও বাধ্যতামূলক শ্রমের খবরের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। আমি দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করছি যে, সুদানী কর্তৃপক্ষ এসব খবরের ব্যাপারে বিন্দুমাত্র কোন আগ্রহ দেখাচ্ছে না। সীমিত সম্পদ ও শক্তি থাকায় সুদান সরকার উপজাতীয় সংঘাত থেকে উদ্ভূত অপহরণ ও মুক্তিপণের ঘটনাগুলোর অবসান ঘটাতে পারছে না।’ ১৯৯৬ সালের আগস্টে জাতিসংঘে নিযুক্ত তৎকালীন সুদানী রাষ্ট্রদূত মাহদী ইব্রাহিম মোহাম্মদ স্বীকার করেন যে, যুদ্ধাঞ্চলে এবং সরকার নিয়ন্ত্রিত এলাকার বাইরে মানবাধিকার পুরোপুরি মেনে চলা হচ্ছে না। রেজেইগাত ও দিনকা সম্প্রদায়ের মধ্যে জাতিগত সংঘাতে শিশুরাও দাসত্বের শিকার হয়েছে। রেজেইগাত সম্প্রদায় শত শত দিনকা শিশুকে আটক করেছে। তবে দক্ষিণাঞ্চলের নিয়ন্ত্রিত পানি ও নতুন চারণভূমি ব্যবহারের সুযোগ লাভের বিনিময়ে তারা এই শিশুদের মুক্তি দেয়ার জন্য দিনকা প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনায় মিলিত হয়। এ প্রসঙ্গেই বলতে গিয়ে ১৯৯৬ সালে সুদানের এক মানবাধিকার পর্যবেক্ষক লরেন্স টুং বলেন, দাসপ্রভুর মানসিকতায় দক্ষিণ সুদানের মানুষদের নিকৃষ্টতর মানুষ হিসেবে দেখা হয়, যাদের অধিকার ইচ্ছামতো লঙ্ঘন করা যেতে পারে। মৌরিতানিয়ার সমাজও জাতিভেদ ব্যবস্থায় কঠোরভাবে বিভক্ত। সেখানে হাল্কা কৃষ্ণবর্ণের মুররা কৃষ্ণাঙ্গদের ক্ষমতা ছেড়ে দিতে রাজিও নয়, প্রস্তুতও নয়। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, মুর থেকে মৌরিতানিয়া নামটি এসেছে। প্রাক-ঔপনিবেশিক, ঔপনিবেশিক ও স্বাধীনতাউত্তর যুগে এই মুররাই সমস্ত ক্ষমতা কুক্ষিগত করে ছিল এবং এখনও আছে। সেখানকার কিছু কিছু এলাকায় বংশানুক্রমিক দাসত্বের প্রচলন আছে। তবে মৌরিতানিয়া ও সুদান ছাড়াও অন্যান্য সাহেল অঞ্চল যথা মালি, নাইজার, শাদে বংশানুক্রমিক দাসত্বের শতাব্দী প্রাচীন ধারা স্থানবিশেষে লক্ষ্য করা যায়। আবার মানবপাচারের মধ্য দিয়ে দাসত্বের অন্যান্য রূপও গড়ে উঠেছেÑ যেমন শিশু সৈনিক ও শিশু শ্রমিক। দাসত্বের চিরায়তরূপের সঙ্গে এর হয়ত কোন মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না। তথাপি মূল বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়ে এই দুইয়ের পার্থক্য সামান্যই। সূত্র : আল আহরাম উইকলি
×