ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আবুল মাল আবদুল মুহিত

শ্রদ্ধাঞ্জলি ॥ অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী

প্রকাশিত: ০৭:০৩, ২৩ নভেম্বর ২০১৪

শ্রদ্ধাঞ্জলি ॥ অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী

গত ১১ নবেম্বর বাংলাদেশের সাহিত্য ও বুদ্ধিজীবী মহলের একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র অধ্যাপক কবি জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী ইন্তেকাল করেন (ইন্না লিল্লাহি...রাজিউন)। অধ্যাপক সিদ্দিকী ঝিনাইদহে ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯২৮ সালে এক শিক্ষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৯৪৭ সালে তিনি ইন্টারমিডিয়েট আর্টসে (বর্তমানে এইচএসসি) কৃতিত্বের সঙ্গে পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগে ভর্তি হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫০ এবং ১৯৫১ সালে ইংরেজী সম্মানে প্রথম বিভাগে প্রথম হওয়ার বিরল কৃতিত্ব অর্জন করেন। তারপর তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৪ সালে বিএ পাস করে ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেন। কিছুদিন ঢাকা কলেজে অধ্যাপনা করে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যান। সেখানে তিনি প্রায় ১৮ বছর অবস্থান করেন এবং তাঁর নানামুখী প্রতিভা তখনই বিকশিত হয়। সেখানে অধ্যাপক মুস্তাফা নুরউল ইসলামের সঙ্গে মিলে তাঁরা একটি সাহিত্য পত্রিকা ‘পূর্বমেঘ’ প্রায় ১০ বছর ধরে নিয়মিতভাবে প্রকাশ করে চলেন। ১৯৭৬-৮৪ পর্যন্ত দুই মেয়াদে তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেন। অতঃপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে পরবর্তীতে সারাজীবন সংশ্লিষ্ট থাকেন। ১৯৯০-৯১ সালে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের প্রথম এক ধরনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের তিনি মাননীয় উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর প্রধান পরিচয় তিনি শিক্ষক এবং কবি। প্রাবন্ধিক এবং অত্যন্ত রুচিশীল একজন ভদ্রলোক হিসেবেও সুপরিচিত ছিলেন। তাঁর ইন্তেকালের পর পরই আমি ক’দিনের জন্য বিদেশ চলে যাই বলে এত দেরিতে তাঁর ওপরে কিছু লিখতে বসছি। অবশ্য, বলে রাখা ভাল যে, মন্ত্রীর দায়িত্বে থাকাকালে এসব লেখার সুযোগ ব্যাপকভাবে কমে গেছে, বলতে গেলে শুধুমাত্র শ্রদ্ধানিবেদনের কয়েকটি প্রবন্ধে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। ১৯৫১ সালের জুলাই মাসে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে সলিমুল্লাহ হলে ভর্তি হই। আমার সম্মানের বিষয় ছিল ইংরেজী এবং সেই বিভাগে জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী তখন এমএ’র একজন মেধাবী ছাত্র এবং কবি-সাহিত্যিক হিসেবে সুপরিচিত। হলে আমার কামরাটি তাঁর কামরা থেকে খুব দূরে ছিল না। আমি জানতাম যে, সর্বজনাব জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী এবং বিচারপতি হাবিবুর রহমান বেশ ঘনিষ্ঠ ছিলেন এবং তাঁদের আমরা খুব সমীহ করতাম। কিছুদিনের মধ্যে তাঁর সঙ্গে সরাসরি পরিচয় হয়। তিনি স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে আমার সম্বন্ধে জানতে চান। হলের বেশ কয়েকজন ভাল ছাত্র তখন পড়ুয়া হিসেবে খুবই সুপরিচিত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে শেলী ভাই ও জিল্লুর ভাই ছিলেন অন্যতম। তখন আমি জানতে পারি যে, তাঁরা দুই বন্ধু হল ইউনিয়নের নির্বাচনে অংশ নিয়ে ১৯৫১ সালে যথাক্রমে সহ-সভাপতি ও সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হন। কিন্তু তাদের বাজেটটি পাস না হওয়ায় ওই সময়ে গোটা ইউনিয়ন বাতিল হয়ে যায়। আমরা জানতে পারলাম, একটি ত্রিদলীয় হল নির্বাচনে তাঁরা যদিও জিতেছিলেন কিন্তু নির্বাচনের পর অন্য দুই দল একত্রিত হয়ে তাঁদের বাজেট পাস করতে দেয়নি এবং গণতান্ত্রিক আচরণের নিয়মে নির্বাচিত কর্মপরিষদটি বাতিল হয়ে যায়। সলিমুল্লাহ হলের ইতিহাসে এমন ঘটনার আর কোন নজির আছে বলে আমি জানি না। তবে এখন তো বছরের পর বছর ছাত্র ইউনিয়নের নির্বাচনই হয় না। জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীকে ঠিক বন্ধু বলব না, জিল্লুর ভাই বলে তাঁকে যে সম্বোধন করতাম তাতে বন্ধুত্ব, শ্রদ্ধা এবং সম্মান মিশ্রিত ছিল। ছাত্রাবস্থায় তাঁর সঙ্গে একটি বিষয়েই প্রায় যোগাযোগ হতো। আমার একটি সাইকেল ছিল এবং তিনি মাঝে মধ্যে আমার সাইকেলটি চেয়ে নিতেন। আর একটি বিষয়ের জন্য তিনি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেন। আর সেটা ছিল তাঁর নিজের জীবনের একটি দিক। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের তাঁর চেয়ে দুই বছরের কনিষ্ঠ একজন ছাত্রীকে নিয়ে মাঝে মধ্যে রেসকোর্সের পাশের রাস্তা দিয়ে মেয়েদের তৎকালীন ছাত্রাবাসে হাঁটতেন। তাঁদের অত্যন্ত সংযত ও শালীন ব্যবহার সবাইকে মুগ্ধ করত। সেই মহিলাই আমাদের ভাবি বেগম কায়সার সিদ্দিকী। বিভাগোত্তরকালে সম্ভবত পাঁচ বছর এক ধরনের সেশনজট ছিল। সেজন্য জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, বিচারপতি হাবিবুর রহমান, সাংবাদিক সৈয়দ মোহাম্মদ আলী, প্রশাসক সাবের রেজা করিম, উপাচার্য ফজলুল হালিম চৌধুরী, আণবিক বিজ্ঞানী আনোয়ার হোসেন এঁরা সবাই ১৯৫২ সালের জানুয়ারিতে তাঁদের স্নাতকোত্তর পরীক্ষা দেন এবং সে কারণেই আমরা তাঁদের কিছুদিনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখতে পাই। আমার মনে হয় ১৯৫১ সালের স্নাতকোত্তর ক্লাসটিতে এক ঝাঁক নক্ষত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদচারণা করেন। সিদ্দিকী সাহেব নিয়মিতভাবে সরকারী বৃত্তি পেয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যান এবং সেখান থেকে সম্মানের সঙ্গে বিএ পাস করে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। এখানে ঢাকা কলেজে সামান্য কিছুদিনের জন্য তিনি নিয়োজিত ছিলেন। কিন্তু তাঁর কর্মক্ষেত্র কিছুদিনের মধ্যেই রাজশাহীতে স্থানান্তরিত হয়। এই সময় তাঁর সঙ্গে খুব বেশি সংযোগ ছিল না। শুধুমাত্র ১৯৫৫ সালে আমার স্নাতকোত্তর পরীক্ষাতে বহিরাগত সদস্য হিসেবে মৌখিক পরীক্ষা বোর্ডের তিনি সদস্য ছিলেন। তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয়ের সূত্রপাত হয় ঢাকায়, মোটামুটিভাবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পরে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনি যখন উপাচার্য ছিলেন তখন মাঝে মধ্যে তাঁর সঙ্গে সংযোগ ছিল। তার পরবর্তী সময়ে তাঁর সঙ্গে সংযোগের সূত্র ছিল বাংলা একাডেমি এবং বাংলাদেশের সেনাশাসন আমলের সক্রিয় বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠীর আসরে। ১৯৮৬ সাল থেকে আমি বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করি। অবশ্য, তাঁর কিছুদিন পরেই প্রায় পাঁচ বছরের জন্য আমাকে স্বেচ্ছা নির্বাসনে যেতে হয়। ১৯৯৩ সালে ড. কামাল হোসেন ‘গণতান্ত্রিক ফোরাম’ নামে একটি চিন্তাকোষ স্থাপন করেন। সেই চিন্তাকোষে জনাব সিদ্দিকী সাহেবের মতো দেশপ্রেমিক বুদ্ধিজীবীরা প্রথমদিকে অংশগ্রহণ করেন এবং আমিও তাঁর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলাম। বুদ্ধিজীবীরা একটি জাতীয় মেনিফেস্টো প্রণয়নের উদ্যোগ নেন এবং আমি তার সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত ছিলাম। সিদ্দিকী ভাই এ সময় এই মেনিফেস্টোর জন্য শিক্ষাবিষয়ক একটি প্রতিবেদন পেশ করেন। কিন্তু যখন এই গণতান্ত্রিক ফোরাম একটি সুন্দর মেনিফেস্টো গ্রহণ করার পর গণফোরাম নামক রাজনৈতিক দলে এই চিন্তাকোষটি পরিবর্তিত হলো তখন শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবীরা এতে আর সংশ্লিষ্ট থাকেননি। তাঁরা তখন নির্দলীয়-নিরপেক্ষ বুদ্ধিজীবী হিসেবে তাঁদের জাতীয় দায়িত্ব পালনে বিভিন্ন উদ্যোগ নেন এবং এরকম উদ্যোগের সঙ্গে জনাব সিদ্দিকী তাঁর শেষ সময় পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট থাকেন। তাঁর মৃত্যুর বোধহয় মাসখানেক আগে কোন এক ফোরামে আমরা একসঙ্গে এক মঞ্চে ছিলাম এবং সেখানেই তাঁর সঙ্গে আমার সর্বশেষ মোলাকাত হয়। তখন তিনি অভিযোগ করেন যে, অসুখ-বিসুখ না থাকলেও বয়সের ভারে তত ভাল নন। জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী অত্যন্ত উন্নতমানের বুদ্ধিজীবী ছিলেন এবং আমার মনে হতো তিনি দেখতে যেমন সুন্দর ছিলেন, মন-মানসিকতায় তেমনি সুশ্রী ছিলেন। সংযত বক্তব্য ও সহজাত গাম্ভীর্য তাঁর চালচলন, লেখাপড়া এবং চেহারার সঙ্গে খুবই মানাতো। তাঁকে কালেভদ্রে রাগ করতে দেখেছি; কিন্তু সে বিরাগ খুব বেশি সময় থাকত না। তাঁর রচিত বিভিন্ন গ্রন্থে তাঁর উন্নত মন এবং মুক্তচিন্তার নজির পাওয়া যায়। আর একটি বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা দরকার, সেটি হলোÑ চালচলনে এবং কথাবার্তায় তিনি যেমন সংযত, ঠিক তেমনিভাবে তাঁর কাজকর্মেও তিনি খুবই পরিশ্রমী ছিলেন। রাজশাহী থেকে ১০ বছর ধরে একটি সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ খুব সহজ ব্যাপার ছিল না। তাঁর সম্পাদিত বাংলা একাডেমির ডিকশনারিতে তাঁর পরিশ্রম ও লেখাপড়ার শুদ্ধতার পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি কবিতাগ্রন্থ ছাড়াও অনেকগুলো মূল্যবান বই লিখেছেন। আমি তাঁর সব প্রকাশিত গ্রন্থ সম্বন্ধে অবহিত নই। তবে আমার যে ক’টি জানা আছে সেই ১১টির নাম এখানে লিপিবদ্ধ করছিÑ ১. বাংলা একাডেমি প্রকাশিত ইধহমষধ ঃড় ঊহমষরংয উরপঃরড়হধৎু, ২. হৃদয়ের জনপদে : কবিতা সঙ্কলন (১৯৭৫), ৩. চাঁদ ডুবে গেলে : কবিতার বই (১৯৮০), ৪. বাঙালীর আত্মপরিচয়, ৫. শব্দের সীমানা, ৬. ঞযব ঈড়ংঃ ভড়ৎ ধ ঈরারষ ঝড়পরবঃু, ৭. ঞযব ঈড়ংঃ ভড়ৎ ঞৎঁঃয, ৮. বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার সঙ্কট ও সম্ভাবনা, ৯. ঝবপঁষধৎ চযরষড়ংড়ঢ়যু ড়ভ অৎড়ল অষর, ১০. ঐরমযবৎ ঊফঁপধঃরড়হ রহ ইধহমষধফবংয : ১৯৪৭-১৯৯২, ১১. যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারে ছিলাম। তিনি সাহিত্য ক্ষেত্রে ১৯৭৭ সালে আলাওল পুরস্কার এবং ১৯৭৯ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান। আমাদের সরকার ২০১০ সালে তাঁকে দেশের সর্বোচ্চ সম্মান স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদান করে। একটুখানি সন্তুষ্টি যে তাঁর জীবদ্দশায় আমরা তাঁকে জাতীয়ভাবে সম্মানিত করি। বিলম্বিত শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদনের জন্য তাঁর পরিবারবর্গের কাছে এবং সুধী সমাজের কাছে আমি ক্ষমাপ্রার্থী। ২১ নবেম্বর ২০১৪ লেখক : সরকারের অর্থমন্ত্রী
×