ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

কৃষিজমিতে ভূমিখেকোদের আগ্রাসন ৩ ॥ ভালুকায় বর্জ্য দূষণে সাড়ে ৫শ’ হেক্টর জমিত

প্রকাশিত: ০৫:১০, ২৩ নভেম্বর ২০১৪

কৃষিজমিতে ভূমিখেকোদের আগ্রাসন ৩ ॥ ভালুকায় বর্জ্য দূষণে সাড়ে ৫শ’ হেক্টর জমিত

রাজন ভট্টাচার্য ॥ ভালুকার ১১টি ইউনিয়নের মধ্যে আটটি ইউনিয়নের কৃষিজমি এখন আর খুব একটা ফাঁকা নেই। দিন দিন খোলা মাঠ আর সবুজ প্রান্তর কমে আসছে। অপরিকল্পিত শিল্পায়ন, দখল, বিক্রিসহ নানা কারণে অকৃষি খাতে যাচ্ছে ফসলের জমি। দখল আর বিক্রির কারণে প্রাকৃতিক জলাভূমিও এখন হাতে গোনা। সরকারী হিসেবে প্রায় ৩০ বছরে ফসলি জমি কমেছে আট হাজার হেক্টরের বেশি। প্রায় সাড়ে ৪০০ হেক্টর পতিত খাস জমির হদিস নেই। যে যার সুবিধামতো এই জমি দখলে নিয়েছে। অনেক সময় প্রশাসনের অজান্তেই বেহাত হয়েছে জমি। দখল আর দূষণের মুখে মৃতপ্রায় এক সময়ের খরস্রোতা খিরু নদী। স্থানীয় কৃষি বিভাগের দাবি, সম্প্রতি ১৫ ভাগ কৃষিজমি হ্রাস পেয়েছে। ভরাডেবা এলাকায় অবস্থিত এক্সপেরিয়েন্স মিলের দূষিত বর্জ্যে ইতোমধ্যে সাড়ে পাঁচ শতাধিক কৃষকের ৩৫০ হেক্টর জমিতে আর ফসল হচ্ছে না। প্রশাসন বলছে, কৃষিজমি সুরক্ষায় আইন না হওয়া পর্যন্ত কিছু করার নেই। কেউ জোর করে জমি দখল করে শিল্পকারখানা স্থাপন করতে চাইলে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার কথা জানিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। জানতে চাইলে ভালুকা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কামরুল আহসান তালুকদার জনকণ্ঠকে বলেন, দিন দিন এলাকায় কৃষিজমি কমছে, তা সত্য। বাস্তবতা হলো, ব্যক্তিমালিকানাধীন কোন জমি কেউ বিক্রি করলে আমাদের করণীয় কিছু থাকে না। তিনি বলেন, যে পর্যন্ত কৃষিজমি সুরক্ষা আইন পাস না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত জমি রক্ষায় প্রশাসনিক কোন উদ্যোগ নেয়া সম্ভব নয়। আইনের বিভিন্ন দিক থাকবে, সেসব দিক বিবেচনা করেই জমি রক্ষায় উদ্যোগ নেয়া সম্ভব হবে। আইনে কৃষিজমি অকৃতি খাতে যেন না যেতে পারে তা নিশ্চিত করা হবে। আমরা চাই দ্রুত আইনটি পাস করা হোক। তিনি বলেন, কেউ নিজ থেকে যোগাযোগ না করলে আমরা জানতেও পারি না জমি বিক্রির কথা। ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে আপোসের মধ্য দিয়েই জমি বিক্রি হয়ে থাকে। জোর করে জমি দখলের পর সেখানে কেউ শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপন করতে চাইলে আমরা ব্যবস্থা নিতে পারি। এ ধরনের কোন অভিযোগ পেলে অবশ্যই কৃষিজমি রক্ষায় স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের প্রতিশ্রুতি দেন তিনি। ১৯৯০ দশকের হিসেব মতে ভালুকায় আবাদি জমির পরিমাণ ছিল ২৭ হাজার ৯৫৫ হেক্টর। এর মধ্যে আমন, বোরো, সবজি ও ফলের চাষযোগ্য জমি ছিল পুরোটাই। বর্তমানে তা হ্রাস পেয়ে সেচকৃত ১৯ হাজার ৫০০ হেক্টরে এসে দাঁড়িয়েছে। বনভূমি রয়েছে ৯ হাজার ২২৭ হেক্টর এবং পতিত জমি ৪২৫ হেক্টর। অর্থাৎ ১৫ শতাংশ আবাদি জমি হ্রাস পেয়েছে বলে কৃষি বিভাগের দাবি। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে ভালুকা অংশ (মাস্টারবাড়ি নাসির গ্লাস থেকে ভরাডোবা নিশিন্দা বিএসবি স্পিনিং মিল পর্যন্ত ২২ কিলোমিটার কৃষিজমি শিল্পায়নের কারণে এখন আর চেনার উপায় নেই। কৃষিজমিতে গড়ে ওঠা শিল্প কারখানার মধ্যে রয়েছে ভরাডোবার নিশিন্দা এলাকায় বি এস বি স্পিনিং মিল, কৃষিবিদ গ্রুপ, বাশার স্পিনিং মিল, এক্সপেরিয়েন্স টেক্সটাইল মিল, মুলতাজিম স্পিনিং মিল, সীমা স্পিনিং মিল, প্যাট্রিয়ট স্পিনিং মিল, ঢাকা কটন মিল, (কাঠালি) রাসেল স্পিনিং মিল, (ধামশুর) কনজিউমার নিটসহ অন্তত শতাধিক কারখানা আবাদি জমির ওপর গড়ে উঠেছে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের দুই পাশে ভালুকা অংশে ব্যাপকভাবে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের আইন অমান্য করে জলাভূমি ভরাট হচ্ছে। এসব জমিতে দ্রুততম সময়ের মধ্যে শিল্প প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করা হবে। সে প্রস্তুতিই চলছে জোরেসোরে। এদিকে ভরাডোবা এলাকায় অবস্থিত এক্সপেরিয়েন্স মিলের দূষিত বর্জ্যে ইতোমধ্যে ৫৫০ কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং জমির পরিমাণ ৩৫০ হেক্টর। পরিবেশ অধিদফতর ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের ভর্তুকি হিসেবে মিল কর্তৃপক্ষকে এক কোটি ৪৯ লাখ টাকা জরিমানাও করেছে। তাছাড়া খিরু নদী পুরোটাই ধ্বংস করে ফেলেছে পৌর এলাকায় অবস্থিত শেফার্ড ডায়িং ইন্ডাস্ট্রিজ, আর্টি ডায়িংসহ কয়েকটি ডায়িং ফ্যাক্টরির বিষাক্ত বর্জ্য।ে এসব ফ্যাক্টরি কর্তৃপক্ষ তাদের ইটিপি স্থাপন করলেও খরচ বাঁচানোর জন্য অধিকাংশ সময়ই ইটিপি বন্ধ রাখে এবং এই দূষিত বর্জ্য সরাসরি খিরু নদীতে ফেলছে। শিল্প এলাকা হবিরবাড়ি ইউপি চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মোর্শেদ আলম জনকণ্ঠকে বলেন, চীনে ব্যাপকহারে শিল্পায়ন হচ্ছে। আমাদের দেশের শিল্পায়নের বিকল্প কিছু নেই। নিজ এলাকায় শিল্পের কারণে কৃষিজমি বেহাত হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কৃষিজমি তেমন একটা কমেনি। কৃষকের জমি তাদেরই আছে। তাহলে শিল্পায়ন কোথায় হচ্ছে? এমন প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি। মোর্শেদ আলম পরে বলেন, কৃষিজমি কিছু কমলেও মানুষের জীবনযাত্রার মান বেড়েছে। কেউ কষ্টে নেই। এলাকার অনেকেই সামান্য জমি বিক্রি করে ব্যবসাবাণিজ্য করে ভাল আছেন। কৃষিজমি হ্রাস বিষয়ে ভেবে লাভ নেই বলেও পরামর্শ দেন এই চেয়ারম্যান। ১১ ইউনিয়নই ছিল কৃষিনির্ভর ॥ ভালুকায় ইউনিয়নের সংখ্যা ১১। এক সময়ে সব ইউনিয়নেই কৃষিনির্ভর অর্থনীতি ছিল। এখন পুরো উপজেলায় কৃষিনির্ভর অর্থনীতি বলা যাবে না। আগে শিল্প। তারপর কৃষি। রাজধানীর খুব কাছাকাছি এই থানা। এছাড়া ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশে। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল হওয়ায় এলাকার জমিতে শিল্প স্থাপনের রীতিমতো ধুম চলছে। তবে তা আজ থেকেও নেই। অন্তত ২০ বছর ধরে এ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। উপজেলার ১১ ইউনিয়নের মধ্যে এখন পর্যন্ত শিল্পায়ন হয়নি এর সংখ্যা তিনটি। এগুলো হচ্ছে ডাকাতিয়া, কাচিনা ও উথুরা ইউনিয়ন। এর বাইরে আট ইউনিয়নের বেশিরভাগ কৃষিজমি এখন বেহাত হয়ে গেছে। এছাড়াও ভরাডোবা, হবিরবাড়ি ইউনিয়নের বনের জমি বেহাত হয়েছে অনেক। জমি উদ্ধারে স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোন তৎপরতা নেই। অভিযোগ আছে, প্রশাসনের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ভূমিদস্যু চক্র নানা কায়দার এসব জমি হাতিয়ে নিয়েছে; যাকে বলে জীবনের জন্য দান। অফেরতযোগ্য। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, মল্লিকবাড়ি কৃষি অধ্যুষিত এলাকা হলেও এখন আর সেই চিত্র নেই। বদলে গেছে এই ইউনিয়ন পরিষদের মাটির প্রকৃতি। ভরাডোবা এলাকায় নির্মিত এক্সপেরিয়েন্স টেক্সটাইলের প্রায় পুরো জমিতেই এক সময় আবাদ হতো। একই ইউনিয়নের যেখানে ঢাকা কটন মিল করা হয়েছে সেখানে পুরোটাই ছিল ডোবা। ধানও হতো প্রচুর। জমি কেনার পর অন্য জায়গা থেকে মাটি এনে ভরাট করা হয়েছে। খিরু নদীর কান্না ॥ উপজেলায় নদী একটিই। নাম ‘খিরু’। সকলের কাছে প্রিয় নাম এটি। নদীর পরিচিতিও বেশ। যারা একটু প্রকৃতিপ্রেমিক তাদের কাছে নদী নিয়ে ইতিহাস আর গল্পের যেন শেষ নেই। এক সময় খরস্রোতা ছিল নদিটি। দখল, দূষণে নদীটি এখন বেহাল। নাব্য নেই। বর্ষায়ও আগের মতো গর্জন হয় না। হারিয়ে গেছে জীববৈচিত্র্য। বর্ষার কয়েকমাস নৌকার দেখা মিললেও শুকনো মৌসুমে নদীর অনেক স্থানই শুকিয়ে যায়। হেঁটে পারাপার হন স্থানীয় লোকজন। এলাকাবাসী জানিয়েছেন, এক সময় নদীর দু’পারে অনেক ধানচাষ হতো। ভূমিহীন বা সাধারণ কৃষক নিজেদের মতো করে ধান চাষ করত। নদীর দু’পারে এখন অবৈধ স্থাপনার শেষ নেই; যে যার মতো নদীর জায়গা দখলে নিয়েছে। নির্মাণ করেছে বিভিন্ন ধরনের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে বসতবাড়ি। পার ঘেঁষে যাদের বাড়ি তারা নিজের মনে করেই দখলে নিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের জমি। কে দেখবে এসব। অর্থাৎ বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধার কেউ নেই। স্থানীয় লোকজনের ভাষায়, কোথাও ফাঁকা থাকলেও এখন নদীর জমিতে চাষের কোন সুযোগ নেই। এলাকায় যত মিল ফ্যাক্টরি হয়েছে তার বেশিরভাগেরই বর্জ্য বিশুদ্ধ করার কোন ব্যবস্থা নেই। অর্থাৎ কারখানার বিষাক্ত বর্জ্যরে লাইন দেয়া হয়েছে নদীতে। ফল হলো- নদীর পানির রঙ বদলে গেছে। স্বাভাবিক রং হারিয়ে পানি রঙিন হয়েছে। কৃষকের ভাষ্য, রঙিন পানি কৃষিকাজে ব্যবহারের অযোগ্য। পানি বিষাক্ত হওয়ায় জীববৈচিত্র্যও ধ্বংস হয়েছে। পরিস্থিতি এমন যে ১০ বছর পর নদীটির অস্তিত্ব থাকবে কিনা এ নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। সব মিলিয়ে মৃত খিরু নদী কাঁদছে। বার বার বাঁচার আকুতি জানাচ্ছে।
×