ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সীমানা নিশ্চিত না করে পিলার স্থাপন ॥ ভূমিদস্যু পেটে তুরাগ বালু

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ১৯ নভেম্বর ২০১৪

সীমানা নিশ্চিত না করে পিলার স্থাপন ॥ ভূমিদস্যু পেটে তুরাগ বালু

রশিদ মামুন ॥ সীমানা নিশ্চিত না হয়ে পিলার (খুঁটি) স্থাপন করায় তুরাগ বালু চলে গেছে ভূমি দস্যুদের পেটে। আবাসন প্রকল্প থেকে শুরু করে ইটভাটা বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে তৈরি পোশাক কারখানা আর সিমেন্ট ফ্যাক্টরি গিলে ফেলেছে তুরাগ আর বালু নদী। সরকার নিজেই সীমানা পিলার স্থাপন করে নিজেই বলছে এসব খুঁটি স্থাপন করা ঠিক হয়নি। সর্বনিম্ন দশ বর্গফুট থেকে শুরু করে তিন লাখ ৯০ হাজার বর্গফুটের দফলদারকে সরকারীভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তদন্তে দেখা গেছে, কয়েক হাজার পিলার নদীর পেটের মধ্যে স্থাপন করা হয়েছে। পুনরায় জরিপ না করে সীমানা পিলার স্থাপন স্থগিত রাখারও সুপারিশ করেছে সরকার গঠিত একটি মূল্যায়ন কমিটি। অভিযোগ উঠেছে উচ্চ আদালতের নির্দেশ অমান্য করে সংশ্লিষ্ট জেলাপ্রশাসন বিভিন্ন ব্যক্তি এবং গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষায় তৎপর ছিল বলেই এমনটা ঘটেছে। পরিবেশবাদী আর সংবাদ মাধ্যম বার বার বিষয়টি তুলে ধরলেও এসব খুঁটি স্থাপনের সময় বার বার সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছে সবকিছু ঠিক ঠাকভাবে করা হচ্ছে। পরবর্তীকালে তদন্ত করে স্বীকার করা হয়েছে সঠিকভাবে পিলার স্থাপন করা হয়নি। সরকারী তদন্ত প্রতিবেদনই বলছে, আমিন মোমিন হাউজিং, চন্দ্রিমা উদ্যান হাউজিং, ড্যানিশ হাউজিং, উত্তরা সিটি, গ্লোবাল সিটি, জলসিড়ি আবাসন প্রকল্প এবং কপতক্ষ সিটির মতো সাতটি আবাসন প্রকল্প তুরাগ এবং বালুর মধ্যে গড়ে উঠেছে। এদের কেউ কেউ বালু ফেলে এর মধ্যে নদী ভরাট করেছে। আর কেউ কেউ সাইনবোর্ড গেড়ে দখলের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। আবাসন প্রকল্পর অত্যাচারই বালু আর তুরাগ মরতে বসেছে। তদন্ত প্রতিবেদনে স্পষ্ট করেই বলা হচ্ছে নদীর সংখ্যা অনুযায়ী তীর ভূমি সংরক্ষণ করে নদীর সীমানা পিলার স্থাপন করা হয়নি। তুরাগ এবং বালুর বিভিন্নস্থান এতই সংকীর্ণ যে নিরাপদ নৌপরিবহনের কোন নিশ্চয়তাই নেই। এ জন্য নৌপথকে সর্বনিম্ন ১০০ মিটার প্রশস্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে। একটু আশ্চর্যজনক হলেও তদন্ত কমিটি তার দুই নম্বর সুপারিশেই বলছে প্রয়োজনে তুরাগ এবং বালুর যেসব জায়গা বেশি সরু সেখানে জমি অধিগ্রহণ করে হলেও নদীকে প্রশস্ত করতে হবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকার বৃত্তাকার নৌপথের এমন অবস্থা হয়েছে যে দখলদারদের কাছ থেকে উল্টো জমি কিনে এখন নদী বাঁচাতে হবে। পরিবেশবাদীরা বলছেন, দীর্ঘদিন থেকে অবহেলা করে আসায় এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। অনেক জায়গাতেই মাত্র ১০০ মিটারও প্রশস্ত নয় তুরাগ এবং বালু। গত ১৫ থেকে ২০ বছর ধরে এই নদী বাঁচানোর আন্দোলন হচ্ছে। সরকারের পালাবদলের খেলায় সংশ্লিষ্টরা একটু নড়ে চড়ে বসেন। তবে এতে নদী বাঁচার বদলে আরও মরে। আর প্রভাবশালীরাই নদীর ওপর জবরদখল করে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নদীর অবৈধ দখলদার উচ্ছেদের নির্দেশ দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী দখলদার ক্ষমতাধর-প্রভাবশালী হলেও এই উচ্ছেদের আওতায় পড়বেন। প্রশ্ন হচ্ছে নদীর দখল দূষণ রোধ করার জন্য সরকারের বিভিন্ন সংস্থা রয়েছে। তারা বছরজুড়ে কি করেন। তাদের কাজটাই বা কি? যে এসব ক্ষেত্রে সরকার প্রধান কথা না বলে তারা কিছু করতে পারেন না। তদন্ত কমিটির মতে তুরাগ এবং বালুর অন্য বড় দখলদারদের মধ্যে রয়েছে, এমবিসি ইটভাটা, এমআরএইচ ইটভাটা, মীর আক্তার সিমেন্ট রেডিমিক্স, এ্যাগ্রোভিটা, ক্রাউন সিমেন্ট রেডিমিক্স, গাও গেরাম কমিউনিটি সেন্টার, এনডিও রেডিমিক্স (সেভেন রিংস) সিমেন্ট, সাজিদ ওয়াসিং প্ল্যান্ট, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, আজমীর গার্মেন্টস, এমএন ফেব্রিক্স, আনোয়ার গ্রুপ, জাবের জোবায়ের গং, প্যারাডাইস এবং তিশা গ্রুপ। ভূমি মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব রফিউল আলমকে আহ্বায়ক করে গঠিত ১০ সদস্যর কমিটি তাদের সুপারিশে বলছে জেলা প্রশাসন, পরিবেশ অধিদফতর, পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং বিআইডব্লিউটি এর সমন্বয়ে যৌথ পরিদর্শন টিম গঠন করে অন্তত মাসে একবার পরিদর্শনের ব্যবস্থা করতে হবে। একই সঙ্গে দেশের গুরুত্বপূর্ণ নদী রক্ষায় সরকার গঠিত কমিশনের কাছে একটি যৌথ প্রতিবেদন পেশ করতে হবে। সীমানা পিলার ঠিক মতো না স্থাপন করে ওয়াকওয়ে নির্মাণ না করার জন্যও সুপারিশ করেছে এই কমিটি। তারা বলছে সীমানা পিলার না বসিয়ে যেসব ওয়াকওয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে তা স্থগিত করতে হবে। তুরাগের ২৫টি জায়গায় সীমানা পিলার স্থাপনে ভুল করেছে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসন। এর মধ্যে ঢাকা জেলার কাটাসুর মৌজায় ৮৯১ এবং ৮৯২ নম্বর দাগের পূর্ব এবং পশ্চিম দিক দিয়ে তুরাগ প্রবাহিত হয়েছে। সেখানে পশ্চিমে ১১ পিলার স্থাপনের ফলে পূর্বে নদী ভরাটের সুযোগ তৈরি হয়েছে। এতে তিন লাখ ৯০ হাজার নদীর জমি আমিন-মোমিন হাউজিং বালু ফেলে ভরাট করেছে। এর কিছু দূরেই এমবিসি ইটভাটা নদী দখল করেছে। জেলার শ্যামপুর মৌজায় ৪২ এবং ৪৩ নম্বর পিলারের পাশে বালুর ড্রেজার রেখে নদীকে দখল করেছে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। রামচন্দ্রপুর মৌজায় চন্দ্রিমা উদ্যান নামের একটি হাউজিং নদীভরাট করছে। এই মৌজার ৪০ থেকে ৪৪ এবং ৫০ থেকে ৫৪ এই ১০টি পিলার স্থানীয়রা সরিয়ে নদীর মধ্যে নিয়ে পুনরায় স্থাপন করছে। বড়বরদেশী মৌজায় এমআরএইচ ইটভাটার পাশে ৮৩, ৮৪ এবং ৮৫ নম্বর পিলার নদীর হাইওয়াটার মার্ক ফোরশোর থেকে ৫০ ফুট ভেতরে স্থাপন করা হয়েছে। একই মৌজায় সিএস ১২৭৪ দাগেও একইভাবে আরও ১০টি পিলার বসানোতে স্থানীয় ভূমি মালিকরা নদী দখল করেছে। ইছাকাবাদ মৌজায় ৩৯টি পিলার নদীর ৬০ থেকে ৭০ ফুট ভেতরে, মিরপুর মৌজায় ৬টি পিলার ১৫০ ফুট নদীর ভেতরে স্থাপন করা হয়েছে। হরিরামপুর মৌজায় এক থেকে ১৩ নম্বর পিলারের মধ্যে শ্মশানঘাট, রিকশার গ্যারেজ এবং বস্তিঘর রয়েছে। জোহরাবাদ মৌজায় নদীর মধ্যে মসজিদ এবং বাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে। কাউন্দিয়া মৌজায় ১৪৪টি পিলারই ফোরশোর নির্ধারণ করে বসানো হয়নি। এগুলো আরও ১৫০ থেকে ১৭০ ফুট নদীর মধ্যে বসানো হয়েছে। একই অবস্থা গোড়ানচটবাড়ি মৌজায়। দ্বিগুণ মৌজায় ফোরশোর অনুসরণ না করে পিলার স্থাপন করায় ড্যানিশ হাউজিং বালু ফেলে, মীর আক্তার সিমেন্ট কারখানা নির্মাণ করে নদীর ফোরশোর এবং একইভাবে এগ্রোভিটা সীমানা পিলারের তোয়াক্কা না করেই নদী দখল করেছে। একই মৌজায় সাভার অংশে গাও গেরাম কমিউনিটি সেন্টার নির্মাণ করে নদী দখল করা হয়েছে। গ্রাম ভাটুলিয়া মৌজায় এনডিই রেডিমিক্স (সেভেন রিংস) সিমেন্ট কারখানা জমি দখল করেছে। একই মৌজায় সাভার অংশে কোন পিলার দৃশ্যমান নেই। মিরপুর থেকে রানাভোলা অর্থাৎ মিরপুর, দ্বিগুন, দেউল, আসুতিয়া, ধউর, ভাটুলিয়া, এবং রানাভোলা মৌজায় ৫৬০টি পিলার ফোরশোর অনুসরণ করে বসানো হয়নি। এখানে সব পিলারই নদীর মধ্যে বসানো হয়েছে। জেলার ফয়দাবাদ মৌজায় ১০টি পিলার বসানো হয়নি এখানে আজমীর গার্মেন্টস এবং এমএন ফেব্রিক্স নদী দখল করেছে। উত্তরখান মৌজায় ৭টি পিলার ২০ থেকে ২৫ ফুট নদীর মধ্যে স্থাপন করা হয়েছে। মোশাহিদ মৌজায় ২০ হাজার বর্গফুট জমি রশিদ অটোবিক্স দখল করে নিয়েছে। এখানে পিলারও তুলে ফেলা হয়েছে। উজানপুর মৌজায় উত্তরা সিটি এবং গ্লোবাল সিটি নদীর ভেতরে সাইনবোর্ড গেড়েছে। নির্নীয়চক মৌজায় ৯ থেকে ১২ নম্বর পিলার ১২০ থেকে ১৫০ ফুট ভেতরে স্থাপন করা হয়েছে। স্থানীয়রা নদী দখল করে বালু, ইটপাথরের ব্যবসা করে। তুরাগের গাজীপুর অংশেও দখল আর দখলদারদের থাবা পড়েছে। জেলার মাছিমপুর মৌজায় ৬৫ ও ৭৮ নম্বর পিলার ৭০ ফুট নদীর মধ্যে বসানো হয়েছে। এখানেই সাজিদ ওয়াশিং প্ল্যান্ট নামের একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। একই মৌজায় অন্যপাশে ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল সেন্ট্রাল মেডিক্যাল কলেজের স্থাপনা নদীর মধ্যে নির্মাণ করা হয়েছে। আব্দুল্লাপুর মৌজায় তাহসিন ফিলিং স্টেশনের পিছনের তিনটি পিলার ৪০ ফুট নদীর মধ্যে স্থাপন করা হয়েছে। একই মৌজায় আরও ৫টি সীমানা পিলার স্থাপন না হওয়াতে আব্দুল্লাহপুর এবং আরিচপুর মৌজায় নদী দখলের স্বীকার হয়েছে। জেলার পাগাড় মৌজায় পিলার ঠিক মতো না বাসনোতে আনোয়ার গ্রুপ, জাবের জোবায়ের, প্যারাডাইস নদী দখল করেছে। হারবাইদ মৌজায় ১৫০ ফুট নদীর ভেতরে পিলার স্থাপন করা হয়েছে। কিছু কিছু জায়গার পিলার তুলে ফেলেছে স্থানীয়রা। তুরাগের মতোই পিলার স্থাপনে বালুতেও যাচ্ছে তাই করেছে জেলাপ্রশাসন। অনুসন্ধানে ১৪টি জায়গায় ত্রুটি দেখা গেছে। এইসব স্থানেই নদীর অনেক ভেতরে পিলার স্থাপন করা হয়েছে। গাজীপুরের তালিয়া ও মাঠবাড়ি মৌজায় সি এস ও আর এস নক্সা অনুযায়ী প্রথমে পিলার স্থাপন না করে নতুন পিলার স্থাপন করায় বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে। মাঠবাড়ি মৌজায় বিনিময় প্রোপার্টিজ এর নামে সাইনবোর্ড স্থাপন করে বালুকে দখল করা হয়েছে। নারায়ণগঞ্জ এলাকার বড়কাও মৌজায় রাজউক পূর্বাচল সংলগ্ন এলাকায় পিলার নেই, ঢাকার তালনা মৌজায় স্থাপিত পিলার হেলে পড়েছে, নারায়ণগঞ্জের ভোলানাথপুরে নির্ধারিত দূরত্ব অনুসরণ না করেই পিলার স্থাপন করা হয়েছে। ঢাকা জেলার ঢেলনা মৌজায় মসজিদ সংলগ্ন তিনটি পিলার ১৫ ফুট নদীর মধ্যে স্থাপন করা হয়েছে। মস্তল মৌজার পূর্বাচল ব্রিজের কাছে আনুমানিক সাত হাজার ৫০০ বর্গফুট নদীর জমি দখল করে বাড়ি বানানো হয়েছে। ইউসুফগঞ্জ মৌজায় ঢাকার অংশে ৪০ ফুট এবং নারায়ণগঞ্জ অংশে ৩০ ফুট নদীর মধ্যে বসানো হয়েছে। এখানে মসজিদ এবং দ্বিতল বাড়ি নির্মাণ করে নদী দখল করা হয়েছে। নারায়ণগঞ্জের পাশি মৌজায় ইছাপুর ব্রিজ ও বাজারসংলগ্ন এলাকায় পিলার ঠিক মতো না বসানোতে পাঁচ হাজার বর্গফুট এলাকায় বালু ভরাট করে পল্ট্রি খামার গড়ে তোলা হয়েছে। পাতিয়া মৌজায় ২০টি পিলার ঠিকমতো বসানো হয়নি। তিশা গ্রুপ নদী দখল করেছে। রায়রাজানি মৌজায় ছোলেমান ভূইয়া নামে এক ভূমিদস্যু ৩০ হাজার বর্গফুট নদী দখল করেছে। এর কিছু দূরে জলসিড়ি আবাসন প্রকল্প নদী দখল করেছে। নারায়ণগঞ্জের কায়েমসার মৌজায় কপতক্ষ সিটি নামে আরেকটি আবাসন প্রকল্প রয়েছে। এখানেও কোন সীমানা পিলার দেখা যায়নি।
×