ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বদলে যাচ্ছে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচী

প্রকাশিত: ০৫:০৭, ১৩ নভেম্বর ২০১৪

বদলে যাচ্ছে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচী

হামিদ-উজ-জামান মামুন ॥ চাল বা গম চুরি, ওজনে কম দেয়া, প্রকৃত উকারভোগী বাছাইয়ে স্বজনপ্রীতি এমন নানা অপবাদ সহ্য করতে হয় ইউনিয়ন পরিষদের জনপ্রতিনিধিদের। কিন্তু এখন আর সেসব দুর্নাম হজম করতে হবে না তাদের। বদলে যাচ্ছে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মনসূচী। ব্যাপক পরিবর্তন আসছে চলমান কর্মসূচীতে। ফলে ইউনিয়ন পরিষদের ওপর থেকে দীর্ঘদিনের দুর্নাম ঘুচবে এবং সেই সঙ্গে সরকারী সম্পদের অপচয়ও কমবে বলে আশা করা হচ্ছে। এজন্য ইতোমধ্যেই জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলপত্রের খসড়া চূড়ান্ত করেছে পরিকল্পনা কমিশন। সম্প্রতি এটি অনুমোদন লাভ করেছে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচীর কেন্দ্রীয় পরিবীক্ষণ কমিটির সভায়। শীঘ্র এ কৌশলপত্রটি যাচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর দফতরে। প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করার পরই চূড়ান্ত অনুমোদন লাভ করবে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) সভায়। এ বিষয়ে কৌশলপত্র তৈরির দায়িত্বে নিয়োজিত পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য ড. শামসুল আলম জনকণ্ঠকে বলেন, নতুন কৌশলপত্রে খাদ্যপণ্য বাদ দিয়ে সামাজিক নিরাপত্তায় অন্তর্ভুক্তদের নগদ টাকা দেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর দারিদ্র্য ম্যাপ এবং দরিদ্র তথ্য ভা-ারের তথ্য অনুযায়ী প্রকৃত উপকারভোগী বাছাই করা হবে এবং তাদের টাকা সরাসরি ব্যাংক এ্যাকাউন্টে চলে যাবে। তখন চেয়ারম্যান ও সদস্যরা ইচ্ছা করলেই তাদের পরিচিত ও আত্মীয়স্বজনের নাম অন্তর্ভুক্ত করতে পারবে না। ফলে দুর্নীতি ও অপচয় কমে আসবে। সেই সঙ্গে ইউনিয়ন পরিষদের দীর্ঘদিনের দুর্নাম ঘুচে যাবে। এতে তারা অপবাদমুক্ত হবেন। সূত্র জানায়, খসড়া কৌশলপত্রে বলা হয়েছেÑনতুন জাতীয় সামাজিক সুরক্ষা কৌশলপত্র (এনএসপিএস) থেকে সুফল পেতে হলে প্রশাসনিক পরিবর্তন আনতে হবে। কারণ চলমান যেসব কর্মসূচীতে খাদ্য বিতরণ করা হচ্ছে, তাতে অনেক অপচয়, অনিয়ম ও দুর্নীতির সুযোগ রয়েছে। ২০ কেজির পরিবর্তে ১২ কেজি চাল দেয়ার অভিযোগও রয়েছে। এসব অভিযোগ থেকে পরিত্রাণ পেতে খাদ্যের পরিবর্তে টাকা হস্তান্তর করা যেতে পারে। অনলাইন ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে তা বিতরণ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে দেশে হঠাৎ বন্যা, ঝড় হলে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় খাদ্যশস্যভিত্তিক কর্মসূচীর ব্যবস্থা থাকবে। আর বাকি সব কমর্সূচী হবে নগদ টাকাভিত্তিক। এ ছাড়া সত্যিকারের দরিদ্র জনগোষ্ঠী যাতে করে সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় কর্মসূচীর সুবিধা ভোগ করতে পারে, সেটি নিশ্চিত করতে সারা দেশে অতিদরিদ্রদের একটি স্বচ্ছ তালিকা প্রণয়নের প্রস্তাব করা হয়েছে। সারা দেশে চলমান ৯৫টি কর্মসূচী কমিয়ে আনা হবে পঁচের নিচে। পাশাপাশি যে ৩০টি মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থা এসব কর্মসূচী তদারক করছে, তার সংখ্যা নেমে আসবে দুটিতে। এছাড়া একটি নতুন জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা সংস্থা তৈরি এবং প্রশাসনিক নানা সংস্কারের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ বিষয়ে সিরাজগঞ্জ জেলার কালিয়া হরিপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বলেন, সরকারের এটি একটি ভাল উদ্যোগ। তবে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচীতে অন্তর্ভুক্তদের টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে এ কৌশলপত্রে ব্যাপক প্রস্তাবনা থাকতে হবে। পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, খসড়া সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলপত্রে এবারই প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচীগুলোকে নিয়ে আসা হয়েছে একটি লাইফ-সাইকেলের আওতায়। জন্ম থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মোট পাঁচটি লাইফ-সাইকেল চালুর প্রস্তাব করা হয়েছে। অতিদরিদ্র, ক্ষতিগ্রস্ত ও প্রতিবন্ধী সবাইকে এই লাইফ-সাইকেলে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। প্রস্তাব অনুযায়ী প্রথমত, সারা দেশে শূন্য থেকে চার বছর বয়সী পর্যন্ত যেসব অতিদরিদ্র, প্রতিবন্ধী ও ক্ষতিগ্রস্তশিশু এবং পরিবার রয়েছে, তাদের প্রতি পরিবারকে মাসে ৮০০ টাকা হারে দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। দ্বিতীয়ত, পাঁচ থেকে ১৮ বছর বয়সী ১ কোটি ৭৯ লাখ স্কুলগামী শিক্ষার্থী যারা রয়েছে তাদের জনপ্রতি মাসিক ২৪০ টাকা করে দেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। যদিও তারা এখন ১২০ টাকা করে পাচ্ছে। তৃতীয়ত, ১৯ থেকে ৫৯ বছর বয়সী ৩২ লাখ দুস্থ মহিলাদের জনপ্রতি মাসিক ৮০০ টাকা হারে দেয়া যেতে পারে। ১০ লাখ প্রতিবন্ধীর মাসিক ৮০০ টাকা হারে প্রদান করার প্রস্তাব করা হয়েছে। চতুর্থত, যাদের বয়স ৬০ থেকে ৮৯ তাদেরও ৮০০ টাকা করে দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। পঞ্চমত, যাদের বয়স ৯০-এর ওপর তাদের মাসে তিন হাজার টাকা হারে দেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে কৌশলপত্রে। আর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সরকার যা নির্ধারণ করে দেবে তাই প্রযোজ্য হবে। সরকার এরই মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য প্রতিমাসে পাঁচ হাজার টাকা করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ বিষয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, আমরা চাই জিডিপির ৩ শতাংশ যাতে সামাজিক নিরাপত্তায় ব্যয় হয়। এটি যেন সঠিকভাবে যাদের পাওয়া দরকার তাদের হাতে পৌঁছে সে ব্যবস্থা করতে পারলেই দারিদ্র্য নিরসনের লক্ষ্য পূরণ হবে। সে জন্য তৈরি করা হচ্ছে সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলপত্র। সম্প্রতি সিরাজগঞ্জ উপজেলার কালিয়া হরিপুর ইউনিয়নের ৭,৮ ও ৯ নং ওয়ার্ডের মহিলা সদস্য সাহিদা শারমিন জনকণ্ঠকে বলেন, এখন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচীর আওতায় যে পরিমাণে বরাদ্দ পাই তা চাহিদার তুলনায় অতি সামান্য। ফলে ওয়ার্ডের অসহায় গরিব মানুষের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হচ্ছি। বরাদ্দ যদি বৃদ্ধি পায় এবং সিস্টেমে পরিবর্তন আসে এটা ভাল হবে। ৮ নং ওয়ার্ডের সদস্য সবুর আলী, কাওয়াকোলা ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ড সদস্য আব্দুস সালাম, চার নং ওয়ার্ড সদস্য আবুল কালাম শেখসহ অনেক সদস্যই একই ধরনের মন্তব্য করেন। ছোট কয়রা গ্রামের বয়স্কভাতা প্রাপ্ত হামিদা বানু (৭০) জানান, বাবা এখন যে টাকা পাই তা দিয়া কিছুই হয় না। এটা বাড়ানো হয় তাহলে খুব ভাল হইত। বর্ণি গ্রামের বয়স্কভাতা প্রাপ্ত আমির মুন্সী, বড় কয়রা গ্রামের নওসের আলী, জোহর আলী, জিয়ারপাড়ার সোহরাব আলীসহ অনেকেই প্রায় একই মন্তব্য করেন। সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসক বিল্লাল হোসেন বলেন, সরকারী যে নির্দেশনা ও নীতিমালা রয়েছে সে হিসেবেই বয়স্ক ভাতার উপকারভোগী নির্বাচন করা হয়। তারপরও বিভিন্ন সময় অভিযোগ আসে। কারণ যেখানে ১২ হাজার লোক (উদাহরণ হিসেবে) সামাজিক নিরাপত্তায় আসার মতো হয়, সেখানে যদি বরাদ্দ থাকে দুই হাজার তাহলে বাড়তি ১০ হাজার মানুষতো বঞ্চিতই থাকে। তখন তারা যেকোন সময় অভিযোগ তুলতেই পারে। সূত্র জানায়, গত বছর এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) এক প্রতিবেদনে বলেছে, দেশের সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার আওতার বাইরে বিপুলসংখ্যক গরিব ও দুস্থ মানুষ রয়েছে। আর এটি তাদের বেকারত্ব, ভগ্নস্বাস্থ্য ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো ঝুঁকি আর অপ্রত্যাশিত বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় দারিদ্র্য ডাটাবেজ করছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। ডাটাবেজ তৈরি প্রকল্পের উদ্দেশ্যর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, একটি সমন্বিত সামাজিক নিরাপত্তা নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের জন্য সকল সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচীকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে সহায়তা করা। প্রকল্পটি জুলাই ২০১৩ হতে ডিসেম্ব ২০১৭ মেয়াদে বাস্তবায়িত হচ্ছে।
×