ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শিশির ভেজা আঙ্গিনা-শীত এখন ভয়ের নয়, উপভোগের

প্রকাশিত: ০৪:২১, ১৩ নভেম্বর ২০১৪

শিশির ভেজা আঙ্গিনা-শীত এখন ভয়ের নয়, উপভোগের

সমুদ্র হক ॥ হেমন্তের মধ্যভাগে ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ার লুকোচুরি খেলায় দুয়ারে নবান্নের সুঘ্রাণে গোধূলী বেলার হলদেটে আভায় কুয়াশার আগমনী জানিয়ে দিচ্ছে শীত এবার কিছুটা আগেভাগেই আসছে। প্রকৃতির কাছে থাকা কোন মনডুবুরিও বলে দেয় এবার অগ্রহায়ণের সঙ্গে শীত মিতালি করেছে। যমুনার ধীর লয়ের স্রোতের ঢেউ এবং নদী তীর ও খেয়াঘাটের নৌকার হালকা বৈঠাতেই চলাচল শুকনো মৌসুম বা শীতের ইঙ্গিত দিয়েছে। এবারের মৌসুম অনেকটাই বিচিত্র। বাংলার ষড়ঋতুর শরৎ হেমন্ত অনেকটাই গুলিয়ে ফেলেছে। ঋতুরানী (বা রাজা) বসন্ত শীতের মধ্যেই উঁকি দেয় হলদে গাঁদা ও লাল গোলাপের শুভ্রতায়। বাঙালীর ঋতু বলতে চোখে দেখা প্রকৃতি বলে দেয় গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শীত। বাকি তিনটি লুকিয়ে থাকে এগুলোর মধ্যে। বসন্তকে প্রকৃতির ফুল পাখি দিয়ে বিশ্বের কবি সাহিত্যিকরা টেনে না আনলে তারও বেহাল অবস্থাই হতো। এতকিছুর পরও বাঙালীর সব কিছুই ছাপিয়ে প্রতিবার ঋতু আসে নববধূর সাজে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের গানের কথায় “বধূ কোন আলো লাগল চোখে...”। এমন বর্ণিল আলো নিয়েই এবার ধ্রুপদী তালে আসছে শীত নবান্ন ও বসন্ত। মনে হয় সবই একই বৃন্তে বেঁধে ফেলেছে প্রকৃতি। ইতোমধ্যে অনেক স্থানে আমন ধান মাড়াই-কাটাই প্রায় শেষ হয়েছে। আগাম জাতের আমন যেখানে ফলে বিশেষ করে চলনবিল পাড়ে সেখানে শীতে নতুন জাতের ধানের আবাদের কথা ভাবছে গৃহস্থ ও কৃষক। হালে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) কল্যাণে কত জাতের ধান যে মাঠে এসেছে তার ইয়ত্তা নেই। বগুড়া পল্লী উন্নয়ন একাডেমির (আরডিএ) মহাপরিচালক এম এ মতিন ও কৃষি বিভাগের পরিচালক এ কে এম জাকারিয়া বললেন, প্রকৃতির শীত গ্রীষ্ম বর্ষা যেভাবইে আসুক মাঠের কৃষক এখন আর কোন কিছুতেই হতাশ হয় না। ব্রি উদ্ভাবিত ধানগুলো এমনই যে প্রকৃতি বিরূপ আচরণ করলে তা মোকাবিলা করা যায়। যে কারণে বর্তমানের বাংলাদেশ খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পেরেছে। একই কারণে গ্রামীণ অভাব বলে আর কিছু নেই। অভাব আছে শহুরে মধ্যবিত্ত পরিবারে। তাও দিনে দিনে ওভারকাম করার পালা শুরু হয়েছে। মাঠ পর্যায়ে ঘুরে দেখা যায়, এই সময়ে (কার্ত্তিকের শেষ প্রান্তে) সকালের তেরছা রোদ শীতের আমেজ নিয়েই আসে। দুুপুরে কিছুটা গরম মনে হবে, তবে তা কোনভাবেই অসহনীয় ঘাম ঝরে হাপিত্যেশ করার মতো নয়। বেলা তিনটার পরই গোধূলীর আভা চলে আসে। একটু করে শীতল হয়ে ওঠে। কোন গৃহস্থ ও কিষান বাড়িতে ট্রেডেল যন্ত্রে বা বৈদ্যুতিক মোটরে ধান মাড়াইয়ের শররররর শরররর শব্দ পাওয়া যায়। আজকাল আর ধান মাড়াইয়ের জন্য আঁটি বিছিয়ে দুই থেকে চারটি গরুর কাঁধে জোয়াল দিয়ে ধান মাড়াই হয় না। তা অনেক আগেই উঠে গিয়েছে। কৃষিতে আধুনিক যন্ত্র শৈলী এসেছে। কৃষকও নিজেদের ভাবনা চিন্তাকে উন্নত করেছে। কোন না কোনভাবে খাবার জোগান হয়েই যায়। বর্তমানে শাক সবজির আবাদে বিপ্লব ঘটেছে। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে। ধান চাল গম ভুট্টা সরিষার আবাদের পাশাপাশি শাক সবজি বলা যায় পুরো বছরই ফলে। একটা সময় শীতকালীন ফসলকে বলা হতো রবি ফসল। বর্তমানে শীত গ্রীষ্ম বর্ষা বলে কিছু নেই। যখন যে খাবার দরকার তাই ফলান হচ্ছে।.....প্রকৃতির সঙ্গে মানিয়ে চলা মাঠ পর্যায়ের মানুষের কাছে শীত আসে স্বাভাবিক নিয়মে। একটা সময় শীতের আগমনের সঙ্গেই বলাবলি হতো হিমালয় পাদদেশীয় উত্তরাঞ্চলের মানুষ শীত কাহিল হয়ে পড়েছে। শীত যতই পড়ে ততই উত্তরাঞ্চলের মানুষের প্রতি এক ধরনের সহানুভূতি এমনভাবে কাজ করে যা রাজনীতিকরণ হয়ে যায়। অথচ ওইসব সাধারণ মানুষের দুয়ারে তাদের দেখা যায় না। গত ক’বছরে এমনও দেখা গেছে শহরের নির্র্দিষ্ট কয়েকটি এলাকায় শীতবস্ত্র বিতরণের নামে ছবি তোলার মহড়া দেয়া হয়। বড় প্রতিষ্ঠান হলে তো কথাই নেই। টিভি চ্যানেলের রিপোর্টার ও ক্যামেরা পারসন না গেলে বিতরণ শুরুই হয় না। প্রিন্ট মিডিয়ার কর্মীদের এক্ষেত্রে একটু কম গুরুত্ব দিয়ে কখনও ছবিসহ প্রেস রিলিজ পাঠিয়ে জানান দেয়া কি কাজ তারা করেছে। মাঠ পর্যায়ের বাস্তব চিত্র হলোÑ মানুষের জীবন মান বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে কি গ্রাম কি শহর সব এলাকার মানুষ শীতের আগেই শীতের কামড় থেকে রেহাই পেতে আগাম প্রস্তুতি নেয়। বর্তমানে দেশের প্রতিটি এলাকায় এমনকি গ্রামে হাটবাজারে শীতের বস্ত্র সস্তায় বিক্রি হয়। শহরের হকার্স মার্কেট ও প্রধান সড়কের ধারে ফেরি করে বিক্রি হয় শীতবস্ত্র। গ্রামের বেশিরভাগ মানুষের ঘরে এখন লেপ-কাঁথা আছে। গত ক’ বছরে দিনে দিনে যেভাবে উত্তরাঞ্চল থেকে আশ্বিন কার্তিকের তীব্র অভাব (যা মঙ্গা নামে বেশি পরিচিত ছিল) দূর হয়েছে প্রকৃতির শীতের থাবা যতই আসুক তা এত বড় পর্যায়ে নেই, যে উত্তরাঞ্চলের মানুষ তা মোকাবেলা করতে পারবে না। উত্তরাঞ্চলের মানুষ এখন দারিদ্র্য মুক্ত হয়ে সামনের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। এখন তারা শীতকে ভয় পায় না। উল্টো শীতকালকে উপভোগ করে। ভোরের লাল সূর্য আলোর বিচ্ছুরিত রেখা মেলে শীতের সকালে মিষ্টি রোদ এনে দেয়, শিশিরে ভেজা গ্রামের গৃহস্থ ও কিষান বাড়ির আঙিনাও রৌদ্রজ্জ্বল হয়ে ওঠে। এভাবেই শীত আসছে...।
×