ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

যানজট নিরসনে আরেকটি উদ্যোগ ॥ সার্কুলার রেল

প্রকাশিত: ০৪:১৪, ১৩ নভেম্বর ২০১৪

যানজট নিরসনে আরেকটি উদ্যোগ ॥ সার্কুলার রেল

মশিউর রহমান খান ॥ রাজধানী ঢাকার চারদিকে সার্কুলার রেলপথ নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। প্রায় ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ উড়ালপথে চলা এ রেলের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এতে অত্যাধুনিক লাইট রেল (হালকা রেল) পরিচালনা করা হবে। সরকার দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজধানীর চলমান যানজট নিরসনে নির্বাচনী ইশতেহারে এ রেলপথ নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। ইশতেহার বাস্তবায়নের জন্যই সরকার এ রেলপথটি তৈরি করছে বলে জানা গেছে। উন্নত বিশ্বের ন্যায় বাংলাদেশে এ রেল পদ্ধতিটি চালু করা গেলে এটিই হবে দেশে প্রথমবারের মতো কোন বিশেষ পদ্ধতির হালকা রেলের রেলপথ। রেলপথটি কোন্ দিক দিয়ে পরিচালনা করা হবে এরই মধ্যে প্রাথমিক সমীক্ষা শেষে এর নির্দিষ্ট রুট চূড়ান্ত করা হয়েছে। স্ট্যান্ডার্ড গেজ ডাবল লাইন ও বৈদ্যুতিক ব্যবস্থার (ইলেকট্রিক ট্রাকশন) এ রেলে রাজধানীর চারপাশে মোট ৪০টি স্টেশন থাকবে। দীর্ঘ রেলপথ নির্মাণে কারিগরি সমীক্ষার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। সূত্র জানায়, রেলপথটি তৈরির জন্য কারিগরি প্রকল্প প্রস্তাব (টিপিপি) প্রণয়ন করছে রেলওয়ে। রাজধানীর চলমান যানজট নিরসন, ঢাকার আশপাশের এলাকা থেকে প্রতিদিন ঢাকায় আগত নাগরিকদের চলাচলের সুবিধার্থে ও ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারে সুবিধা প্রদান করতেই এ উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। তবে রাজধানীর যানজট নিরসনে প্রণীত মহাপরিকল্পনায় ঢাকার চারপাশে সার্কুলার রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পটি অন্তর্ভুক্ত না থাকায় এর উপযোগিতা নিয়ে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত রয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। রেলওয়ের তথ্যমতে, ঢাকা শহরের বাইরে দিয়ে চারদিকে নির্মাণ করা হবে সার্কুলার রেলপথ। এটি রূপগঞ্জের তারাবো সেতু এলাকা থেকে শুরু হয়ে ইস্টার্ন বাইপাস, আবদুল্লাহপুর, ডিএনডি বাঁধ, লালবাগ, বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী (প্রথম বুড়িগঙ্গা) সেতু এলাকা, কদমতলী হয়ে মোট ৪০টি স্টেশন পার হয়ে আবার তারাবো গিয়ে শেষ হবে। লেভেল ক্রসিংয়ের ঝামেলা এড়াতে পুরো রেলপথটি হবে এলিভেটেড (উড়ালপথে)। আর বৃত্তাকার এ রেলপথে স্টেশন থাকবে ৪০টি। সার্কুলার রেলপথ নির্মাণে কারিগরি সমীক্ষার পাশাপাশি প্রকল্পটির বিস্তারিত নক্সা প্রণয়ন করা হবে। এতে প্রায় ৮০ কোটি টাকা ব্যয় হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অনেকটা মেট্রোরেলের আদলে নির্মাণ করা হবে সার্কুলার রেলপথ। এক্ষেত্রে ৮০ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ, প্রয়োজনীয় জমি অধিগ্রহণ ও ইঞ্জিন-কোচ সংগ্রহে সম্ভাব্য ব্যয় হিসেবে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হবে। এটি বাস্তবায়নে বিদেশী সহায়তার প্রয়োজন হবে। রেলপথটি হবে স্ট্যান্ডার্ড গেজ ডাবল লাইন ও বৈদ্যুতিক ব্যবস্থার (ইলেকট্রিক ট্রাকশন)। এ রেলপথে চালানো হবে অত্যাধুনিক লাইট (হালকা) রেল। এ জন্য ৬ বগিবিশিষ্ট ৩০ সেট ইলেকট্রিক মাল্টিপল ইউনিট (ইএমইউ) কেনা হবে। ট্রেনটি পরিচালনার সময়সূচী হিসেবে বলা হয়েছে অধিকসংখ্যক যাত্রী পরিবহনের স্বার্থে সকাল ৬টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত ৫ মিনিট পর পর দুই দিক থেকেই ট্রেন ছাড়বে। ফলে যাত্রীদের ট্রেনের জন্য দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে না। যখন তখন ট্রেন পাওয়া যাবে বিধায় যাতায়াতকারীর সংখ্যাও বর্তমানের চেয়ে অনেক বেশি বাড়বে। তাছাড়া বর্তমানে রাস্তায় বের হলে শুধু যানজটেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। ট্রেনে চলার মাধ্যমে রাস্তায় কোন যানজট না থাকায় ও সময় সাশ্রয়ী হবে বিধায় রাজধানীতে আগমন ও প্রস্থানকারীগণ বেশি আগ্রহী হবে। এতে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ লাভবান হবে বিধায় রেল কর্তৃপক্ষ এটি তৈরিতে আগ্রহী হয়েছে বলে জানা গেছে। সার্কুলার রেলপথের টিকেট ব্যবস্থায় ব্যবহার করা হবে স্মার্টকার্ড। এর মাধ্যমে কোন যাত্রী বর্তমান ব্যবস্থায় কোন টিকেট ক্রয় করতে হবে না। যাতায়াতকারীগণ প্রতিমাসে বা বছরে একবার নির্দিষ্ট পরিমাণ ফি প্রদান করে একটি স্মার্টকার্ড গ্রহণ করতে পারবেন। স্মার্টকার্ডটি ট্রেনে ওঠার সময় দরজায় রাখা বিশেষ ডিভাইসে টাচ্ করে দূরত্ব বা গন্তব্যের স্টেশনের নাম নির্বাচন করলেই নির্দিষ্ট পরিমাণ ভাড়ার টাকা কার্ড থেকে কেটে নেয়া হবে। কার্ড ছাড়া অন্যথায় কোন যাত্রীকে রেলের ভেতর প্রবেশ করতে দেবে না বলে সূত্র জানিয়েছে। তাছাড়া বর্তমান পদ্ধতির লাইনে দাঁড়িয়ে টিকেট কাটার ঝামেলা থেকেও মুক্তি মিলবে যাত্রীদের। সূত্র জানায়, সার্কুলার রেলপথ নির্মাণে কারিগরি সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে দাতা সংস্থার সহায়তা চাইবে রেলওয়ে। এ জন্য টিপিপি চূড়ান্ত হওয়ার পর বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) কাছে আবেদন করা হবে। অন্যান্য দাতা সংস্থার সহায়তাও চাওয়া হতে পারে। তবে দাতা সংস্থার সাড়া না পেলে সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে কারিগরি সমীক্ষা পরিচালনা করা হবে। প্রসঙ্গত, উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার মেট্রোরেল নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ২২ হাজার কোটি টাকা। এটিও উড়ালপথে নির্মাণ করা হবে। জানা গেছে, ঢাকা শহরের যানজট নিরসনে ২০০৫ সালে প্রণয়ন করা হয় ২০ বছর মেয়াদী কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (এসটিপি)। এতে ৩টি মেট্রোরেল ও ৩টি বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) নির্মাণের কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত প্রথমটির কাজ শুরু করা হয়েছে, যা এমআরটি-৬ নামে পরিচিত। তবে এমআরটি-৪ ও এমআরটি-৫ নামে অন্য দুটি মেট্রোরেল নির্মাণে এখনও কোন সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়নি। বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর হয়ে সায়েদাবাদ পর্যন্ত এমআরটি-৪-এর রুট নির্ধারণ করা আছে। এটি বিদ্যমান রেলপথের ওপর দিয়ে উড়ালপথে বা পাতালপথে নির্মাণের কথা রয়েছে আর এমআরটি-৫ গুলশানের প্রগতি সরণি থেকে শুরু হয়ে কামাল আতাতুর্ক এ্যাভিনিউ, কাফরুল, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, ধানম-ি, তেজগাঁও, রামপুরা, বাড্ডা হয়ে আবার গুলশান যাবে। এটি উড়ালপথে নির্মাণ করতে হবে। তবে বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রস্তাবিত সার্কুলার রেলপথটি এসটিপিতে অন্তর্ভুক্ত নেই। রেল সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সময়ের চাহিদার কারণে এসটিপিতে না থাকা সত্ত্বেও এ সার্কুলার রেলওয়ে নির্মাণ করা অতি জরুরী হয়ে পড়েছে। রাজধানী ও এর আশপাশের লোকদের নির্বিঘেœ যাতায়াতের সুবিধার্থে রেলপথ মন্ত্রণালয় ও রেল কর্তৃপক্ষ যাতায়াত ব্যবস্থায় আধুনিকতা আনতে অতি দ্রুত সার্কেল রেলপথ চালুর বিষয়টি চিন্তা করছে বলে জানা গেছে। এদিকে রাজধানীতে যাত্রীদের চলাচলের সুবিধার্থে সরকার গৃহীত বিচ্ছিন্ন বিভিন্ন প্রকল্পের কারণে এরই মধ্যে এসটিপি বাস্তবায়ন নিয়ে জটিলতা দেখা দিয়েছে। এ জন্য ১০ বছর না পেরোতেই এসটিপি সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে রাজধানীতে চলমান ও প্রস্তুাবিত বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পকে সমন্বয় করা হবে। তবে সংশোধিত এসটিপির ক্ষেত্রেও সার্কুলার রেলপথটি বিবেচনা করা হবে বলে সংশ্লিষ্ট জানা গেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এসটিপিতে প্রস্তাবিত ৩টি মেট্রোরেল ও ৩টি বিআরটিএর মধ্যে আন্তঃসংযোগ রাখা হয়েছে। অর্থাৎ যাত্রীদের একটি পরিবহন মাধ্যম থেকে নেমে আরেকটি মাধ্যমে উঠতে সংযোগ ব্যবস্থার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। এতে পুরো রাজধানী একক নেটওয়ার্কের আওতায় আনা সম্ভব হবে। তবে সার্কুলার রেলপথের সঙ্গে অন্য কোন পরিবহন ব্যবস্থার সংযোগ স্থাপনের পরিকল্পনা রাখা হয়নি। এছাড়া সার্কুলার রেলপথটি শহরের চারপাশ দিয়ে ঘুরলেও এর যাত্রীদের ঢাকায় প্রবেশের কোন পরিকল্পনা নেই এতে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ ব্যবস্থায় রাজধানীতে বসবাসকারীদের এ রেলপথের সুবিধা গ্রহণ করতে ও চলাচলে সমস্যার সৃষ্টি করবে। তাই শুধু রাজধানীর বাইরে নয়, ঢাকার ভেতরে প্রবেশের জন্য চূড়ান্ত রুট নির্ধারণ করতে হবে। অন্যথায় এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য ব্যাহত হতে পারে। পরিবহন বিশেষজ্ঞদের মতে, রাজধানীর পরিবহন ব্যবস্থার আধুনিকায়ন ও যানজট নিরসনে বিক্ষিপ্ত পরিকল্পনা কখনও সুফল বয়ে আনবে না বিধায় এসটিপিতে সমন্বিত পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে ৩টি মেট্রোরেলের কথা বলা হয়েছে। তবে বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রস্তাবিত সার্কুলার রেলপথটি এসটিপিতে অন্তর্ভুক্ত না থাকায় প্রকল্পটির উপযোগিতা নিয়ে অবশ্যই প্রশ্ন উঠতে পারে। এটি সমাধানে যুগোপযোগী করে চলমান এসটিপিতে এটি অন্তর্ভুক্ত করে এ সার্কেল রেলপথটি চালু করলে এর চূড়ান্ত সুফল মিলবে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মোঃ তাফাজ্জল হোসেন বলেন, রাজধানীতে দীর্ঘ বছরের চলমান সঙ্কট যানজট নিরসনে ও যাত্রীদের চলাচলের পথ নির্বিঘœ করতে ঢাকা শহরের চারদিকে সার্কুলার রেলপথ নির্মাণের উদ্যোগ হাতে নেয়া হয়েছে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী তা বাস্তবায়ন করতে রাজধানীর চারপাশে এ বৃত্তাকার রেল (সার্কুলার) চালুর চিন্তা করা হচ্ছে। এটি নির্মাণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি প্রদানের পর এর টিপিপি প্রণয়ন শুরু হয়েছে। শীঘ্রই এর কারিগরি সমীক্ষা শুরু করা হবে। সার্কুলার রেলপথটি হবে বিশ্বের বিভিন্ন আধুনিক শহরের আদলে। প্রায় মেট্রোরেলের আদলে তৈরি হবে এ রেলপথ। এ জন্য ব্যয় অনেক বেশি হবে। কিন্তু কত হবে তা কারিগরি সমীক্ষার আগেই বলা সম্ভব নয়। তবে লাইট রেল ব্যবহার করায় ব্যয় মেট্রোরেলের চেয়ে কিছুটা কম হবে। এছাড়া যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য সরকারের নেয়া চলমান সকল পরিকল্পনার সঙ্গে সমন্বয় করেই এটি চালু করা হবে। স্ট্যান্ডার্ড গেজ ডাবল লাইন ও বৈদ্যুতিক ব্যবস্থার (ইলেকট্রিক ট্রাকশন) এ রেলে ৪০টি স্টেশনসহ প্রায় ৮০ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ করা হবে। এ রেলপথে চলতে যাত্রীরা টিকেটের পরিবর্তে ব্যবহার করবে আধুনিক স্মার্টকার্ড। প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত প্রতি ৫ মিনিট পর পর দু’দিক দিয়ে চলবে এ ট্রেন। ফলে চলাচলের যানবাহনের আর কোন সমস্যাই থাকবে না। এ সার্কুলার রেলপথটি চালু হলে ঢাকার যোগাযোগ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আসবে।
×