ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

জনপ্রতিনিধিদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী ॥ চাকরির জন্য এখানে সেখানে লোকজনকে ধরাধরি করা শিক্ষিত লোকজনের জন্য অবমাননাকর ॥ আমরা চাই যুবসমাজ স্বউদ্যোক্তায় পরিণত হোক

ডিজিটাল সেন্টারে শিং দিয়ে গুঁতোগুঁতি করবেন না

প্রকাশিত: ০৪:৫৯, ১২ নভেম্বর ২০১৪

ডিজিটাল সেন্টারে শিং দিয়ে গুঁতোগুঁতি করবেন না

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চাকরির জন্য ‘দুয়ারে দুয়ারে’ না ঘুরে প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে নিজেদেরই স্ব-উদ্যোক্তা হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য তরুণ প্রজন্মের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, শিক্ষা সমাপনের পর চাকরির জন্য এখানে সেখানে লোকজনকে ধরাধরি করা শিক্ষিত লোকজনদের জন্য অবমাননাকর। আমরা চাই না আমাদের যুবসমাজ তাদের চাকরির জন্য এখানে সেখানে ঘুরাফেরা করুক। আমরা চাই অন্যের ওপর নির্ভর করার পরিবর্তে আমাদের যুবসমাজ স্ব-উদ্যোক্তায় পরিণত হোক, নিজের পায়ে দাঁড়াক এবং অন্যের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করুক। তাই কারও মুখাপেক্ষী না হয়ে তরুণ প্রজন্মকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। একই সঙ্গে ডিজিটাল সেন্টারে উদ্যোক্তাদের কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির চেষ্টা না করতে স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হুঁশিয়ার করেছেন তিনি। মঙ্গলবার রাজধানীর জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে নির্মিত বিশাল প্যান্ডেলে ‘ডিজিটাল সেন্টার উদ্যোক্তা সম্মেলন’ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী এ সব কথা বলেন। ইউনিয়ন তথ্য ও সেবাকেন্দ্র (ইউআইএসসি) হিসেবে পরিচিত সাড়ে ৪ হাজার ডিজিটাল সেন্টারের প্রায় ১১ হাজার উদ্যোক্তা এ সম্মেলনে যোগ দেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এ্যাকসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) প্রকল্পের উদ্যোগে আয়োজিত এ সম্মেলনে উদ্যোক্তারা ছাড়াও বিদেশী কূটনৈতিক, উন্নয়নসহযোগী সংস্থার প্রতিনিধি ও সরকারের উর্ধতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। স্থানীয় সরকার সচিব মঞ্জুরুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেনÑ প্রধানমন্ত্রীর পুত্র তথ্যপ্রযুক্তিবিদ সজীব ওয়াজেদ জয়, এলজিআরডিমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, তথ্য ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক ও ইউএনডিপির বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর পাওলিন তামেসিস। প্রধান অতিথির বক্তব্যে তরুণ উদ্যোক্তাদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য খুব বেশি অর্থের প্রয়োজন হয় না। অর্থও আমাদের রয়েছে। কর্মসংস্থান ব্যাংক থেকে যে কোন যুবক জামানতবিহীন ঋণ নিতে পারবে। তিনি বলেন, নিজের কাজ নিজেই করতে পারবে। মর্যাদা নিয়ে বাঁচতে পারবে। অন্যের মুখ ঝামটা খেতে হবে না। তোমরাই পারবে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। মনে রাখতে হবে আমরা বিজয়ী জাতি। আমরা কারও কাছে মাথানত করে চলি না। তরুণ প্রজন্মকে পাস করার পর চাকরির জন্য ঘুরে বেড়ানোর অভ্যাস পরিত্যাগ করতে হবে। তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে সরকার পরিচালনা সহজ হয়েছে উল্লেখ করে ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তাদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, গোটা পৃথিবী এখন আপনাদের হাতের মুঠোয়। কোনকিছু যখন ভালভাবে চলে তখন অনেকে আসেন সেখানে তাদের মামা, শালা, ভাই বা আত্মীয়দের বসানোর জন্য। তবে আমি সতর্ক করে দিতে চাই- যারা জনপ্রতিনিধি মেম্বার, চেয়ারম্যান, কাউন্সিলর তারা কেউ যেন আমার এই ডিজিটাল সেন্টারে শিং দিয়ে গুঁতোগুঁতি না করে। যারা উদ্যোক্তা, প্রথম শুরু করেছেÑতাদের কেউ সরাতে পারবে না। তাদের স্থান অবশ্যই সেখানে থাকবে। এ সকল ডিজিটাল সেন্টারে কেউ কোন প্রকার হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করবেন না। প্রধানমন্ত্রী বলেন, শুধু জন্ম নিবন্ধনই নয়, আগামীতে মৃত্যু নিবন্ধনও এ সব ডিজিটাল সেন্টারের মাধ্যমে করা যেতে পারে। অন্য দেশগুলোর চেয়ে আমাদের দেশে তরুণের সংখ্যা অনেক বেশি। ভাত-মাছ খেয়ে বড় হওয়া আমাদের তরুণরা অনেক মেধাবী। তরুণদের প্রশিক্ষণ ও শিক্ষা নিয়ে নিজেদের কর্মদক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। ডিজিটাল সেন্টারের এত দ্রুত বিকাশ ও এর মাধ্যমে সেবা মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়াই প্রমাণ করে- আমাদের তরুণরা মেধাবী। উন্নত দেশ গঠনে তরুণদের ভূমিকার প্রশংসার পাশাপাশি ২০২১ সালে মধ্যম আয়ের দেশ ও ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ গড়ার দৃঢ়প্রত্যয় পুনর্ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তাদের উদ্দেশে বলেন, তোমাদের মনে রাখতে হবেÑআমরা পারি, আমরাই পারব। তোমরাই পারবে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। অনেক চড়াইউতরাই পার হয়ে অনেক এগিয়ে এসেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ আরও এগিয়ে যাবে। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আমাদের কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না। সরকার আউটসোর্সিংয়ের জন্য প্রশিক্ষণ দেবে জানিয়ে তিনি বলেন, এখন ঘরে বসে শুধু দেশে নয় বিদেশেও অর্থ উপার্জন করা যায়। এ জন্য প্রশিক্ষণ নিতে হবে, শিক্ষা নিতে হবে। ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারে বসে বিদেশেও কাজ করে অর্থ উপার্জন করতে পারে, সে প্রশিক্ষণও আমরা দেব। প্রধানমন্ত্রী ইন্টারনেটের ধীরগতির কথা স্বীকার করে স্বল্প সময়ের মধ্যে তা দ্রুত করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেন, ইন্টারনেটের গতি সময়োপযোগী না। তবে দেশের জনগণ ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ভোট দিয়ে আমাদের পুননির্বাচিত করেছে। এ জন্য অনেক অসম্পূর্ণ কাজ আমরা শেষ করতে পারব। তিনি বলেন, সরকার ইন্টারনেটের গতি বাড়ানোর পদক্ষেপ নিয়েছে। যেহেতু সেবা বৃদ্ধি পেয়েছে, ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে সুতরাং ইন্টারনেটের এখন যে স্পীড তা সময়োপযোগী না। এর গতি আরও বাড়াতে হবে। তিনি বলেন, হাইস্পীডের ইন্টারনেট চালুর জন্য সরকার পদক্ষেপ নিয়েছে। আমরা নতুন করে সাবমেরিন কেবল স্থাপনের পদক্ষেপ নিয়েছি। আরেকটা পদক্ষেপ নিয়েছি সেটা হলো নিজেরাই বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করব। এটা একনেকে পাস হয়েছে। ইন্টারনেটের গতি বাড়লে প্রযুক্তি আরও বিকাশ হবে, আরও সেবা বাড়বে। তিনি বলেন, দুর্ভাগ্যের বিষয় ১৯৯৬ সালে আমরা ক্ষমতায় আসার পর দ্রুতগতির ইন্টারনেট চালুর জন্য সাবমেরিন কেবল স্থাপনসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছিলাম। কিন্তু সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সেটা পরিবর্তন হয়ে গেছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে জনগণ আমাদের ভোট দিয়েছে। আমরা আবার সরকার গঠন করে নির্বাচিত সরকারের ধারাবাহিকতা রক্ষা হওয়ায় অনেক অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করতে পারছি। ডিজিটাল পদ্ধতির সুবিধার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ এত দ্রুত করতে পারব এটা কেউ ভাবতে পারেনি। ২০০৮ সালে যখন ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখিয়েছিলাম তখন অনেকেই মনে করেছিলেন এটা সম্ভব নয়। তবে আজ আর কেউ বলে না, এটা কিভাবে হবে। শুরুর দিকে চিন্তা ছিল প্রতিটি গ্রামে আমরা সাইবার ক্যাফে করব, সেখান থেকে মানুষ তথ্যসেবা নিতে পারবে। কিন্তু সেটা হয়নি। তবে ২০০৯ সালে আমরা প্রতিটি ইউনিয়নে একটি করে ডিজিটাল সেন্টার করার উদ্যোগ গ্রহণ করি। যদিও তিন বছরের মধ্যে এটা করার কথা ছিল। কিন্তু এক বছরের মধ্যেই ইউনিয়ন পর্যায়ে আমরা এ সেবা পৌঁছে দিতে সক্ষম হই। তিনি বলেন, মানুষ এখন ২০০ ডিজিটাল সেবা গ্রহণ করছে। আমরা ৬৪ জেলায় তথ্য বাতায়ন করেছি। ২৫ হাজার সরকারী দফতরকে যুক্ত করে বিশ্বের বৃহত্তম ওয়েবপোর্টাল ‘জাতীয় তথ্য বাতায়ন’ চালু করেছি। শিক্ষা খাতে ডিজিটালাইজেশনের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, শিক্ষা খাতের উন্নয়নে আমরা তথ্য ও ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহারকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছি। দেশের ২৩ হাজার ৫০০ স্কুলে মাল্টিমিডিয়া ক্লাস রুম করেছি। ২৯ হাজার শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। ই-বুক তৈরি করা হয়েছে। এই ই-বুক পর্যায়ক্রমে ডিজিটাল আর্কাইভে পরিণত করা হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, কম্পিউটার শিক্ষার হাতেখড়ির পাশাপাশি ডিজিটাল শব্দটিও তিনি ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের কাছ থেকেই জেনেছেন। কম্পিউটার শিক্ষায় ছেলের ভূমিকার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, মানুষের শিক্ষাগ্রহণের কিন্তু কোন বয়স নেই। জয় যখন স্কুলে পড়ত, কম্পিউটার নিয়ে আসত; তখন নাড়াচাড়া করে দেখতাম। সে আমাকে কিভাবে টাইপ করতে হয় একটা প্রোগ্রাম দিয়ে দিত। বসে বসে টাইপ করা প্রথমে শিখলাম আমি আর আমার বান্ধবী বেবী মওদুদ। এরপর আমরা এ্যাপল কিনলাম। সেখানে আমাদের অফিসের, পার্টির কাজ করার সঙ্গে সঙ্গে নিজেরাও বসে বসে কম্পিউটার শিক্ষা নিতাম। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কার্যক্রমের সূচনালগ্নের ওপর আলোকপাত করে উদ্যোক্তা সম্মেলনে তিনি বলেন, সারাদেশে সাড়ে চার হাজার ইউনিয়নে ডিজিটাল সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। সেখানে সারাদেশের ১১ হাজার তরুণ-তরুণী কাজ করছে। ক্ষেত্রবিশেষে তারা মাসে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকাও আয় করছে। এটা সম্ভব হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের কারণে। তিনি বলেন, আমরা প্রথমে চেষ্টা করেছিলাম প্রতিটি গ্রামে এই ডিজিটাল সেন্টার স্থাপন করার, যা একটা সাইবার ক্যাফের মতো কাজ করছে। যেখান থেকে গ্রামের মানুষ সরাসরি তথ্যপ্রযুক্তির সুবিধা বা সুফল ভোগ করবে। কিন্তু সেটা হয়নি। তারপর আমরা ইউনিয়ন পর্যায়ে তিন বছরের মধ্যে একসেস টু ইনফরমেশন প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ হাতে নেই। কিন্তু মাত্র এক বছরের মধ্যে আওয়ামী লীগ সরকার এই কাজ শেষ করেছে। আমরা প্রমাণ করেছি, মেধার দিক দিয়ে আমরা বিশ্বের চেয়ে কোন অংশে কম নই। তবে ইন্টারনেট কানেক্টিভিটির দিক দিয়ে আমরা কিছুটা পিছিয়ে উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র বলেন, সেটা গতি ও কোয়ালিটির দিক দিয়ে। আমরা এ নিয়ে কাজ করছি। আশা করছি, আগামী চার বছরের মধ্যে হাইস্পীড ব্রডব্যান্ড কানেকশান আমরা দিতে পারব। এ সময় তিনি নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে বলেন, কিছু দিন আগে আমি রংপুরে গিয়েছিলাম। সেখানে ডিজিটাল তথ্য সেন্টারের কর্মরতদের সঙ্গে কথা বলি। তারাই আমাকে জানায় যে, মাসে তারা ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা উপার্জন করছে। এতে আমি খুব গর্ব অনুভব করি। তিনি আরও বলেন, বিএনপির সময় এই উত্তরবঙ্গেই মানুষ মঙ্গায় অভাবে কষ্ট করত। এখন সেখানে গ্রামে বসে মানুষ কাজ করছে। আপনারা কেউ ভুলবেন না, এটা আওয়ামী লীগ সরকার করেছে। স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেন, ডিজিটাল উদ্যোক্তারা বর্তমানে যে কাজগুলো করছে এর পাশাপাশি তাদের কাজের পরিধি আরও বাড়ানো হবে। জন্ম নিবন্ধন উদ্যোক্তারাই করবে। বাংলাদেশের প্রতিটি সেক্টরের বৈপ্লবিক পরিবর্তন হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ভারতের চেয়েও অনেক এগিয়ে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ডিজিটাল যুগ শুরু হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, আগে মাত্র একটি মোবাইল কোম্পানি ছিল। একেকটা মোবাইল সেটের দাম ছিল ৮০-৯০ হাজার টাকা। ওই সময় আমি লন্ডন থেকে ঢাকা আসার পর পৌঁছানোর খবরটি স্ত্রীকে জানানোর জন্য লন্ডনে একটা ফোন করতে টিএন্ডটি অফিসে আমাকে দুই দিন ঘুরতে হয়েছে। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় না এলে বাংলাদেশ আজও সেই তিমিরেই থেকে যেত।
×