ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শরীয়তপুরে ক্ষোভ

’৭১-এর শিশু আজকের জামায়াত নেতা এখন মুক্তিযোদ্ধা?

প্রকাশিত: ০৪:৪৬, ১২ নভেম্বর ২০১৪

’৭১-এর শিশু আজকের জামায়াত নেতা এখন মুক্তিযোদ্ধা?

আবুল বাশার, শরীয়তপুর থেকে ॥ শরীয়তপুর জেলা সমাজ সেবা অধিদফতরের উপ-পরিচালক জামায়াত নেতা ইউসুফ আলী মিয়া ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা। তার মুক্তিযোদ্ধা সনদ বাতিল করে তাকে প্রচলিত আইনের আওতায় এনে শাস্তির দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠেছেন শরীয়তপুরের মুক্তিযোদ্ধারা। অভিযোগ উঠেছে, সুচতুর জামায়াত নেতা ইউসুফ আলী মিয়া গত জোট সরকারের আমলে মুক্তিযোদ্ধা সনদ সংগ্রহ করে একদিকে যেমন রাষ্ট্রীয় সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে, অপরদিকে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতে ইসলামীর রাজনীনির সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখে জেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করছে। শরীয়তপুর সদর উপজেলার সাবেক সমাজ সেবা কর্মকর্তা মিজানুর রহমান জানান, শরীয়তপুর জেলার ডামুড্যা উপজেলার ধানকাটি ইউনিয়নের চরমালগাঁও গ্রামের কালাচান বেপারির ছোট ছেলে ইউসুফ আলী মিয়া। ১৯৮৫ সাল থেকে তিনি সমাজ সেবা অধিদফতরে কর্মরত রয়েছেন। তার ৩০ বছর চাকরি জীবনের ২৭ বছর আছেন শরীয়তপুরেই। এসএসসি পরীক্ষার সনদ ও সর্বশেষ দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটার তালিকা অনুযায়ী তার জন্ম তারিখ ১৯৫৮ সালের ১ জানুয়ারি। সে অনুযায়ী তার জাতীয় পরিচয়পত্র বা ভোটার আইডি কার্ডেও জন্ম তারিখ ১৯৫৮ সালের ১ জানুয়ারী হওয়ার কথা। কিন্তু অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে সম্পূর্ণ অসৎ উদ্দেশ্যে এবং নিজের বয়স বাড়িয়ে মুক্তিযোদ্ধা সাজার জন্য সুবিধা মতো একাধিক জন্ম তারিখ ব্যবহার করেছেন। ইউসুফ আলী মিয়া তার মূল জাতীয় পরিচয়পত্র জাল করে তাতে জন্ম তারিখ বসিয়েছেন ১ জানুয়ারি ১৯৫৪ সাল। মুক্তিযোদ্ধা ডাটা বেইজ ফরম, ধানকাটি ইউনিয়ন পরিষদ থেকে উত্তোলনকৃত জন্ম সনদ, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা গ্রহণের জন্য সোনালী ব্যাংকে হিসাব খুলতে পূরণকৃত তথ্য ফরম ও সোনালী ব্যাংকে জমাকৃত জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটো কপিতে দেখা গেছে ইউসুফ আলী মিয়ার জন্ম তারিখ ০১-০১-১৯৫৪ সাল। অথচ ২০০৯ সালের ১০ সেপ্টেম্বর তিনি ডামুড্যা উপজেলা সমাজ সেবা কর্মকর্তা হিসেবে চাকরিজীবী মুক্তিযোদ্ধাদের শ্রেণীভিত্তিক তথ্য ফরম এ তিনি তার জন্ম তারিখ উল্লেখ করেছেন ১ জানুয়ারি ১৯৫৮ সাল। চরমালগাঁও গ্রামে ইউসুফ আলীদের বাড়িতে গিয়ে আপন চাচাতো বড় ভাই আনোয়ার উদ্দিন বেপারি ও বড় ভাবী মালেকা বেগমের সঙ্গে কথা বলে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তাঁরা বলেন, ইউসুফ আলী ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি। সে মুক্তিযুদ্ধ করেছে বলে আমরা দেখিনি। এমনকি কখনও শুনিওনি। একই গ্রামের আব্দুল জব্বার মালত বলেন, ইউসুফ বয়সে আমার অনেক ছোট। আমি ৮ বারের চেষ্টায় ১৯৭১ সালে ভারত পৌঁছেছিলাম। সেখানে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে এসে যুদ্ধ করি। তারপরও আমি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পাইনি। আমি প্রকৃত যোদ্ধা হয়েও আজও সনদ পাইনি। তালিকাভুক্ত হতে পারিনি। সে সময়ের একজন শিশু, অমুক্তিযোদ্ধা ইউসুফ আলী কি করে সার্টিফিকেট পেয়েছে তা আমার বোধগম্য নয়। ধানকাটি ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের সাবেক সভাপতি ডাঃ নুরুল ইসলাম ও বর্তমান সভাপতি ইউছুব আলী খান বলেন, ইউসুফ আলী বেপারি মুক্তিযোদ্ধা নন। মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাইয়ের সময় নিয়ম ছিল একজন মুক্তিযোদ্ধা কমপক্ষে তার ৫ সহযোদ্ধার নাম বলবে, সে ভারতে কোথায়, কার অধীনে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছে, বাংলাদেশে কোন সেক্টরে যুদ্ধ করেছে এবং দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কার মাধ্যমে কোথায় অস্ত্র সমর্পণ করেছিল তার পূর্ণাঙ্গ বর্ণনা দিতে। ডামুড্যা উপজেলায় ৩ বার যাচাই-বাছাই হলেও ইউসুফ একবারও নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা প্রমাণ করতে পারেনি। সে জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত। ডামুড্যা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের তিন বারের সভাপতি মোঃ আবুল বাশার বলেন, ১৯৭১ সালে ইউসুফ আলী ডামুড্যা মুসলিম পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের ৭ম শ্রেণীর ছাত্রাবস্থায় আমাদের বাড়িতে লজিং ছিল। সে তখন ১২-১৩ বছরের শিশু। আমার চাচার ছোট ছোট ছেলেমেয়েকে সে পড়াত। পুরো মুক্তিযুদ্ধের সময় সে আমাদের বাড়িতেই ছিল। ১৯৭৪ সালে তিনি ডামুড্যা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু হঠাৎ তিনি মুক্তিযোদ্ধা সনদ কিভাবে পেলেন তা কেউ জানে না, তার মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের কথা একটি গল্পমাত্র। সে অবৈধ পন্থায় সনদ হস্তগত করেছে। আমরা তার সনদ বাতিলের জন্য বার বার মুক্তিযুদ্ধ সংসদ ও মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছি। আমি আশা করব বর্তমান সরকারের ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাবিরোধী শুদ্ধি অভিযানের মাধ্যমে ইউসুফ আলীর সনদ বাতিল হবে। ধানকাটি ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুর রাজ্জাক পিন্টু বলেন, আমি দীর্ঘ ১৪ বছর ধানকাটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছি। আমার ইউনিয়নের ৩০ হাজার বাসিন্দার কারও কাছে কোন দিন শুনিনি ইউসুফ আলী মিয়া একজন মুক্তিযোদ্ধা। তিনি সার্টিফিকেট ক্রয় করে মুক্তিযোদ্ধা সেজেছেন। সে সরকারী চাকরি করেও জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। আমি এই অমুক্তিযোদ্ধার সনদ বাতিলের জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ইউসুফ আলী প্রথমে ১৯৮৫ অস্থায়ী এবং ১৯৮৮ সালে স্থায়ীভাবে সমাজ সেবা দফতরে চাকরিপ্রাপ্ত হন। কিন্তু ১৯৮২ সালের ১৭ নবেম্বর বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নিজস্ব প্যাডে ‘মুক্তি সুপা/শরীয়তপুর/৫০৩৭/৮৪’ নং স্মারকে তৎকালীন কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জাকির হোসেন খান চৌধুরী হারুন এবং এর পরদিন অর্থাৎ ১৯৮২ সালের ১৮ নবেম্বর ‘মুক্তি সুপা/ফরিদপুর/৪৩৮/৮২’ নং স্মারকে তৎকালীন কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মোঃ গিয়াস উদ্দিন বীরপ্রতীকের কাছ থেকে সমাজ সেবা বিভাগে চাকরিপ্রাপ্তির জন্য সুপারিশ ও প্রত্যয়নপত্র গ্রহণ করেছিলেন। একাধিক মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ইউসুফ আলী এসব প্রত্যয়নপত্র নিজে তৈরি করেছে। এগুলো জাল ও ভুয়া। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, মাত্র একদিনের ব্যবধানে একই দফতরের দুই স্মারকে যথেষ্ট গড়মিল রয়েছে। শরীয়তপুর জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সভাপতি আব্দুস সাত্তার খান বলেন, ইউসুফ আলী সম্পর্কে আমরা অনেক অভিযোগ পেয়েছি। আমরা নিজেরা খুব গভীরভাবে খোঁজখবর নিয়ে জেনেছি সে মুক্তিযোদ্ধা নয়। তার সনদ বাতিলের জন্য ইতোপূর্বেও আমরা চেষ্টা করেছি। এখন নতুন করে আবার আমরা পদক্ষেপ নেব। এ বিষয়ে কথা বলতে চাইলে ইউসুফ আলী মিয়া বলেন, আমি ১৯৭১ সালে মে মাসে স্টুয়ার্ড মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ভারতে গিয়ে মেলাগড়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছি। মাত্র ১৫ দিনের প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফিরে যুদ্ধ করেছি। তবে ভারতীয় কোন কর্মকর্তার অধীনে তিনি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন তা বলতে পারেননি। তিনি বলেন, আমার মুক্তিযোদ্ধা আইডি নং-০৩১৫০৫০২৪৪, মন্ত্রণালয় সনদ নং-ম-৩৭০৪, জাতীয় তালিকা নং-৭৭, গেজেট নং-৩৮৯ তারিখ-২৫/০৮/২০০৫, মুক্তিবার্তা লাল বই নং-০১১২০৩০১১২, ভোটর তালিকা নং-১৬ এবং মন্ত্রণালয় কর্তৃক যাচাই ক্রমিক নং-১৪। আমি প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা। একটি মহল সমাজে আমাকে হেয় প্রতিপন্ন করা জন্য আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে।
×