ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ডেটলাইন ১২ নবেম্বর, ১৯৭০

প্রকাশিত: ০৪:১৫, ১২ নভেম্বর ২০১৪

ডেটলাইন ১২ নবেম্বর, ১৯৭০

বাঙালী জাতির জীবনে যে কয়েকটি স্মরণীয় প্রাকৃতিক দুর্যোগ এসেছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ১৯৭০ সালের ১২ নবেম্বর কালরাতের গোর্কির হানা। এ দুর্যোগ শুধু শোকের নয়, এ শোক বাঙালীর শোককে শক্তিতে পরিণত করার জন্যও স্মরণীয় হয়ে আছে। তৎকালীন পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বাঙালী জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে এ দুর্যোগ অন্যতম প্রেরণা যুগিয়েছে। বাঙালীর আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠা, তথা স্বাধীনতা যুদ্ধকে ত্বরান্বিত করেছে। এ শোকের মধ্য দিয়ে বাঙালী তার নিজস্ব জাতিসত্তাকে ঐক্যবদ্ধ ও প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। আমরা লাভ করেছি, আমাদের মহান স্বাধীনতা। ১৯৭০ সালের ১২ নবেম্বর বৃহস্পতিবারের রাত ছিল বাংলাদেশের মানুষের জন্য বিশেষ করে উপকূলের মানুষের কাছে গভীর শোকাবহ এক কালরাত। এদিন উপকূলে আঘাত হেনেছিল শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ও প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়। দিনভর টিপ টিপ বৃষ্টি শেষে রাত সাড়ে আট-নয়টার দিকে বঙ্গোপসাগর প্রচ- আক্রোশে ফুঁসে উঠেছিল। এ সময়ে উপকূলবর্তী এলাকার অধিকাংশ মানুষ অন্যান্য দিনের মতো কাজকর্ম সেরে ঘুমিয়ে পড়েছিল। রেডিওতে ছিল না তেমন কোন আগাম সতর্ক সঙ্কেত। তৎকালীন রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্র থেকে সেদিন পুরো চব্বিশ ঘণ্টায় মাত্র দু’বার স্বাভাবিক আবহাওয়া বার্তা ঘোষণা করা হয়েছিল। তাতে এ ধরনের কোন দুর্যোগের সতর্কবার্তা ছিল না। ছিল শুধু নি¤œচাপ সৃষ্টির খবর। রাত এগারোটার দিকে রেডিও থেকে ‘হ্যারিকেন’ রূপে ঘূর্ণিঝড়ের আঘাত হানার ঘোষণা দেয়া হলেও তা ছিল মানুষের অজানা। কারণ ততক্ষণে বঙ্গোপসাগর তার সর্বশক্তি নিয়ে উপকূলে আঘাত হেনেছে। বঙ্গোপসাগরের ফুলে ফেঁপে ওঠা জলরাশির সঙ্গে ছিল তীব্র গতির স্রোত ও ঢেউ। ছিল প্রচ- বর্ষণ। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ভেসে গিয়েছিল উপকূলের লাখো মানুষ। প্রায় সারারাত ধরে উপকূলের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে আড়াই শ’ মাইল বেগে ভয়াবহ সর্বগ্রাসী ঘূর্ণিঝড়। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন গবেষণার বরাত দিয়ে বলা হয়েছিল, সেদিন রাতে ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্গে সুনামিও আঘাত হেনেছিল। সেদিনের কালরাতের ঘূর্ণিঝড়ে পটুয়াখালী, বরিশাল, বরগুনা, ভোলা, পিরোজপুর, চট্টগ্রামসহ উপকূলবর্তী জেলাগুলোর বিস্তীর্ণ এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। বহু সমৃদ্ধ জনপদ বিশেষ করে উপকূলের অসংখ্য দ্বীপ-চর বিরাণভূমিতে পরিণত হয়েছিল। সেদিন রাতে কত বধূ তার স্বামীকে হারিয়েছে। স্বামী হারিয়েছে স্ত্রী। সন্তানহারা হয়েছে কত দম্পতি। ভাই হারিয়েছে ভাইকে। মা হারিয়েছে তার প্রিয় সন্তানকে। প্রিয় মাকে হারিয়েছে ব্যথাতুর সন্তান। কিংবা স্বজনহারা হয়েছে কত মানুষ, তবে তৎকালীন পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী নিহতের সংখ্যা পাঁচ লাখ বলে মেনে নিয়েছিল। সে সময়কার শাসকগোষ্ঠী ভয়াবহ বিপর্যয়ের এ দুর্যোগের খবরকে ফলাও করে প্রকাশ করতে চায়নি। তারা প্রকৃত সত্য ঘটনাকে চেপে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু দেশী-বিদেশী গণমাধ্যমে এ সংখ্যা ১০ লাখেরও বেশি বলে উল্লেখ করেছিল। সত্তরের এ গোর্কি আমাদের ওই সময়ের জাতীয় জীবনে নানাভাবে প্রভাব ফেলেছিল। বিশেষ করে সত্তরের জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রলয়ঙ্করী জলোচ্ছ্বাসে ব্যাপক প্রাণহানি এবং তৎকালীন পাকিস্তানী শাসক-শোষক গোষ্ঠীর সীমাহীন উদাসীনতা বাঙালীর মুক্তির আকাক্সক্ষাকে তীব্র করে তুলেছিল। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সে সময় নির্বাচনী প্রচারণায় সারাদেশ চষে বেড়াচ্ছিলেন। ঘূর্ণিঝড়ে ব্যাপক প্রাণ ও সম্পদহানির খবর শুনেই বঙ্গবন্ধু লঞ্চ ভর্তি ত্রাণসামগ্রী নিয়ে ছুটে গিয়েছিলেন উপদ্রুত এলাকায়। তিনি উপকূলের অধিকাংশ শহর, গ্রাম, চর ও দ্বীপাঞ্চলে ছুটে গিয়ে স্বজনহারাদের সান্ত¡না দেননি। তাদের পাশে ছায়ার মতো দাঁড়িয়েছিলেন। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে উদ্ধারে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তাদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন ত্রাণসামগ্রী। সে সময় তিনি চরাঞ্চলের মানুষের নানাবিধ সমস্যাকে গভীরভাবে উপলদ্ধি করার সুযোগ পেয়েছিলেন। যার ফলে তিনি স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে চরবাসীর জন্য নিয়েছিলেন নানামুখী উদ্যোগ। যার সুফল আজও চরাঞ্চলের অসংখ্য মানুষ ভোগ করছে। সে সময়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানো ছাড়াও বঙ্গবন্ধু তৎকালীন সামরিক জান্তার দেশের মানুষের প্রতি সীমাহীন অবহেলা-উদাসীনতাকে দেশ-বিদেশের মানুষের চোখের সামনে দৃশ্যমান করে তুলেছিলেন। ওই সময় তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এক সরকারী সফরে চীনে ছিলেন। ঘূর্ণিঝড়ের পরে তিনি বিশেষ বিমানে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ওপর দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডি ফিরে গিয়েছিলেন। বিমানে বসেই তিনি ঘূর্ণিঝড়ে ব্যাপক প্রাণহানির সংবাদ পেয়েছিলেন। কিন্তু এরপরও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া একবারের জন্য উপদ্রুত এলাকা পরিদর্শন করার তাগিদ বোধ করেননি। এমনকি বিমান নিয়ে চক্করও দেননি। যা বঙ্গবন্ধুর মনে গভীর রেখাপাত করেছিল। এই ঘটনায় সাধারণ মানুষ ইয়াহিয়া খানের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল। তারা এর সমুচিত জবাবও দিয়েছিল। ইয়াহিয়া খানের এই আচরণ বঙ্গবন্ধু বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছিলেন। একইভাবে ঘূর্ণিঝড়-পরবর্তী উদ্ধার এবং ত্রাণ তৎপরতা নিয়েও ক্ষমতাসীনদের ব্যর্থতা দেশ-বিদেশে তোলপাড় সৃষ্টি করেছিল। পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানেই বহু বিদেশী সরকারী বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা এবং দেশের বিত্তবানসহ নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ উপকূলের স্বজনহারা মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর এ সমস্ত মহতী তৎপরতা পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনে অনিবার্য প্রভাব ফেলেছিল। আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। এরই ধারাবাহিকতায় জাতির জীবনে আসে ২৬ মার্চের গণহত্যা। আসে মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং সর্বশেষ স্বাধীনতা। সত্তরের ১২ নবেম্বরের পরে ৪৪ বছর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু উপকূলের মানুষ আজও ভোলেনি সেই কালরাতের ভয়ঙ্কর স্মৃতি। এখনও উপকূলের অসংখ্য মানুষ খুঁজে ফেরে জলরাশিতে ভেসে যাওয়া স্বজনদের। শূন্য ভিটায় দাঁড়িয়ে বিলাপ করে বহু মানুষ। সেদিনের সে গোর্কির ছোবলে ক্ষত-বিক্ষতরা আজও বেঁচে আছে অন্তহীন হাহাকার নিয়ে। ১২ নবেম্বরের ঘূর্ণিঝড় আমাদের জাতীয় জীবনে যে গভীর ছাপ ফেলেছিল এবং যার হাত ধরে মুক্তিযুদ্ধকে করেছিল ত্বরান্বিত। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় তার অনেক কিছুই আজ ইতিহাসের পাতা থেকে প্রায় বিস্মৃত হয়ে গেছে। এটি শুধুই একটি সাদামাটা দিনে রূপ নিয়েছে। কিন্তু উপকূলের মানুষ এ দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে উদগ্রীব। উপকূলের মানুষের দাবি দিনটিকে ‘জাতীয় দুর্যোগ দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হোক। এদিনে নেয়া হোক স্বজনহারাদের জন্য নানামুখী কর্মসূচী। নিহতদের আত্মার শান্তি কামনায় হোক বিশেষ প্রার্থনার ব্যবস্থা। একই সঙ্গে আগামী দিনগুলোর ঘূর্ণিঝড় তথা যে কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় এ দিনের শোককে শক্তিতে পরিণত করার জন্য নেয়া হোক যাবতীয় উদ্যোগ। এমনিতেই বৈশ্বিক জলবায়ু উষ্ণতার প্রভাবে বাংলাদেশ যথেষ্ট ঝুঁকির মুখে। উপকূল তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দিন দিন প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে উঠছে। এ সংক্রান্ত গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০৫০ সাল নাগাদ গোটা দক্ষিণাঞ্চল সমুদ্রে তলিয়ে যাবে। এতে অন্তত তিন লাখ মানুষ ‘জলবায়ু উদ্বাস্তু’ হবে। দেশের উত্তরাঞ্চলে বাড়বে খরা। বাড়বে মরুময়তা। এছাড়া, একই সময়ের মধ্যে বাড়বে ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড়সহ নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এরই মধ্যে উপকূলে জোয়ারের উচ্চতা ক্রমে বাড়তে শুরু করেছে। প্রতিবছর উচ্চতার পরিমাণ বাড়ছে। জীব জগতে নানা ধরনের পরিবর্তন লক্ষণীয় হয়ে উঠছে। যদিও সরকার জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে নানামুখী কর্মসূচী বাস্তবায়ন করছে। তারপরও এসবের প্রেক্ষাপটে ১২ নবেম্বরের শোকাবহ দিনটির গভীরতা উপলব্ধি করা প্রয়োজন এবং এরই নিরিখে এ দিনটি হোক ‘জাতীয় দুর্যোগ দিবস’, এটাই উপকূল তথা দেশের মানুষের একমাত্র দাবি। লেখক : সাংবাদিক
×