ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মিথ্যাবাদী মিথ্যাচার

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ১১ নভেম্বর ২০১৪

মিথ্যাবাদী মিথ্যাচার

ভিন্ন ধরনের অনেক পরিস্থিতিতে এবং কখনও কখনও নির্দোষ পরিস্থিতিতে সংবাদপত্র সত্য কথা বলে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এমনটা হয় যখন সত্য তাদের জানা থাকে না। কিংবা যখন তারা এমন কারোর উদ্ধৃতি দেয় যিনি সত্যটা জানেন না। এ জাতীয় ব্যাপার আরও বেশি করে হয় যখন সংবাদপত্র এমন কারোর উদ্ধৃতি দেয় যিনি সত্যকে বিকৃত করেন অথবা কোন ঘটনাকে তাঁর পূর্ব ধারণার উপযোগী করে পরিবেশন করেন। অনুমান করি, আমার বেলায় এই অবিশ্বাসের ব্যাপারটা ভিয়েতনাম দিয়ে শুরু হয়েছিল যখন প্রশাসনের মনে হলো যে, তাদের অনুসৃত নীতির যৌক্তিকতা প্রমাণের জন্য মিথ্যার আশ্রয় নিতে হবে। অথচ কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল যে, তাদের সেই নীতি বা কৌশলে কখনই কোন কার্যোদ্ধার হয়নি। মিথ্যাচারিতা ব্যাঙের ছাতার মতো বিস্তার লাভ করেছিল বিপরীত সংস্কৃতির অর্থাৎ প্রচলিত প্রথার বিপরীত জীবনধারা ও দৃষ্টিভঙ্গির দিনগুলোতে যখন আমাদের সমাজের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান থেকে সেগুলোকে সযতেœ সংরক্ষণ করে রাখা পবিত্র আবরণগুলো ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল। আর এই ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবার ঘটনাগুলো সানন্দে লিপিবদ্ধ করার জন্য সংবাদপত্র যেন তৈরি হয়েই ছিল। ভিয়েতনাম যুদ্ধ, হিপ্পি ও ড্রাগের মতো বিপরীত সংস্কৃতি, পেন্টাগন পেপারস, ওয়াটারগেট, নিক্সনের অবমাননাকর প্রস্থান, এসএ্যান্ডএল স্ক্যান্ডাল, ইরানগেট, উপসাগর যুদ্ধ এগুলো সবই হলো ভয়াবহ গুরুত্বপূর্ণ কাহিনী, ঐতিহাসিক মোড় পরিবর্তনের ঘটনা, যা প্রচুর পরিশ্রম ও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে পরিবেশন করতে হয়েছিল। ভিয়েতনাম যুদ্ধ এবং এই যুদ্ধ সত্যোচ্চারণের অভ্যাস ও সত্যধর্মের, মিথ্যাচারের জোয়ালে আটকে পড়া রাজনীতিবিদদের এবং সরকারের মিথ্যাচারের জালে ধরা পড়া সাংবাদিকদের কী ক্ষতি করেছিল সেটাই প্রথমে দেখা যাক। কেনেডির স্থলাভিষিক্ত হবার ঠিক পর পরই প্রেসিডেন্ট লিন্ডন জনসন তাঁর প্রতিরক্ষামন্ত্রী বব ম্যাকনামারাকে ভিয়েতনামে পাঠিয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন ভিয়েতনাম যুদ্ধ কেমন চলছে ম্যাকনামারার কাছ থেকে সে সম্পর্কে এক নতুন ও তরতাজা ধারণা লাভ করবেন। সময়টা ছিল ডিসেম্বরের শেষদিক কি ১৯৬৪ সালের জানুয়ারির প্রথম দিক। ম্যাকনামারা দিনের পর দিন রণাঙ্গনগুলো সফর করলেন, জেনারেলদের ব্রিফিংগুলো শুনলেন। ভিয়েতনাম থেকে স্বদেশে ফিরে আসার সময় তানসন নাত বিমানবন্দরে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি ঘোষণা করলেন যে, ভিয়েতনামী সেনাবাহিনীর উন্নতি গ্রহণযোগ্য মাত্রায় পৌঁছেছে। সমস্ত লক্ষণ দেখে অগ্রগতির পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে। তবে বিস্ময়ের বিস্ময় হলো, সেই কথাগুলো পেন্টাগন পেপারসে রয়ে গেছে। সাত বছর পর জানা গেল হোয়াইট হাউস চত্বরে নেমেই তিনি প্রেসিডেন্টের কার্যালয়ে ছুটে গিয়েছিলেন এবং তাঁকে বলেছিলেন, ভিয়েতনামে সবকিছু সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছে। জেনারেল ওয়েস্টমেরিল্যান্ড আরও লাখ দুয়েক সৈন্য পাঠানোর জন্য অনুরোধ জানাবেন এবং তিনি অর্থাৎ ম্যাকনামারা সম্ভবত সেই অনুরোধে সমর্থন দেবেন। আমেরিকানরা তাদের নেতৃবৃন্দের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলতে শুরু করেছিল। সেটা সত্য গোপন করার জন্য। সত্য গোপন করা সম্পর্কিত সমস্ত তথ্যই পেন্টাগন পেপারসে আছে। অথচ নিক্সন প্রশাসন জাতীয় নিরাপত্তার দোহাই পেরে পেন্টাগন পেপারস ছাপতে না দেয়ার চেষ্টায় দুটি সংবাদপত্রকে সুপ্রীমকোর্ট পর্যন্ত টেনে নিয়ে গিয়েছিল। এমন ঘটনা আমেরিকার ইতিহাসে প্রথম। সহকারী প্রতিরক্ষামন্ত্রীর মুখটা ছাইয়ের মতো ফ্যাকাশে হয়ে গেল। কারণ উনি পেন্টাগন পেপারস পড়ে দেখেননি। বিচারকের কাছে তিনি কয়েক মিনিট সময় চাইলেন। প্রসিকিউশন দলের সদস্যদের এক সঙ্গে গাদাগাদি হয়ে আলোচনা করতে দেখা গেল। শেষে উনি কাঠগড়ায় ফিরে আসলেন। তখন স্টেনোটাইপিস্ট তাঁকে প্রশ্নটা পাঠ করে শোনালে তিনি বললেন, ‘অপারেশন মেরিগোল্ড।’ এতে আমরা পত্রিকার যারা উপস্থিত ছিলাম তারা সবাই রীতিমতো প্রমাদ গুনলাম। অগত্যা আমাদের পেন্টাগন সংবাদদাতা শুনানির ট্রান্সক্রিপ্টের ওপর দ্রুত চোখ বুলাতে লাগলেন এবং এক জায়গায় ‘অপারেশন মেরিগোল্ড’ কথাটার উল্লেখ পেয়ে গেলেন। কিন্তু ওটা কোন অভিযানের ব্যাপার ছিল না, বরং ছিল হোচিমিনের সঙ্গে একটা সমঝোতার ব্যাপারে পোলিশ কূটনীতিকদের সম্পৃক্ত করতে লিন্ডন জনসনের একটা উদ্যোগের নাম। পরের সপ্তাহে লাইফ পত্রিকার প্রধান নিবন্ধটি ছিল এই অপারেশন মেরিগোল্ড সম্পর্কিত। লিখেছিলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হ্যারল্ড উইলসন। ব্যাপারটা এতই হাস্যকর। এমনকি মুখের ওপর মিথ্যা কথা বলে থাকেন এমন জননেতাদের কিভাবে মোকাবিলা করতে হয় অতি সেরা সেরা পত্রিকাও তা কখনও শিখেনি। দৃষ্টান্তস্বরূপ ওয়াটারগেট সম্পর্কে নিক্সনের প্রথম মন্তব্যটা এইভাবে ছাপতে কোন সম্পাদকই সাহস পেত না : ‘প্রেসিডেন্ট নিক্সন গতরাতে জাতীয় টিভি ভাষণে বলেছেন, ওয়াটারগেট অফিসে তালা ভেঙ্গে ঢোকার ঘটনায় জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়াবলী জড়িত এবং সেই কারণে তিনি এই অদ্ভুত ধরনের চুরির ব্যাপারে মন্তব্য করতে অপারগ। ওটা একটা মিথ্যা কথা।’ আমরা ওটা করতে সাহস পাব না। অথচ ব্যাপারটা তেমনই হওয়া উচিত ছিল এবং ভাল হোক মন্দ হোক আমরা এমন কিছু ছাপতে সাহায্য-সহায়তা করেছি যা সত্য ছিল না, বরং যা ছিল মিথ্যা। কাজেই আমাদের অপেক্ষায় থাকতে হবে, মিথ্যাচার প্রমাণ করার উপায়ের সন্ধান করতে হবে আগ্রাসী পন্থায় এবং এই প্রক্রিয়ায় একঘরে করে ফেলতে হবে সেসব মানুষদের যারা ওটাকে মিথ্যা বলে বিশ্বাস করে না বা বিশ্বাস করতে চায় না। একটা সময় মিথ্যাচারের দুটো ঘটনা পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রাধান্য বিস্তার করে ছিল। প্রতিনিধি পরিষদের স্পীকার নিউট গিংরিচ দু’বছর ধরে অস্বীকার করে এসেছিলেন যে কলেজে তিনি যে কোর্স পড়িয়ে থাকেন তার সঙ্গে তাঁর নিজস্ব রাজনৈতিক এ্যাকশন কমিটি জিওপিএসির সম্পর্ক আছে। আর দু’বছর ধরে সংবাদপত্রগুলোও তাঁর এই অস্বীকৃতির কথাটা পরিবেশন করে আসছিল যদিও বেশিরভাগ পত্রিকা জানত তিনি মিথ্যা বলছেন। অথচ নৈতিকতা কমিটি প্রমাণ পেয়েছিল যে জিওপিএসি নিউটের সেই কোর্সের উন্নয়ন, অর্থ সংগ্রহ ও প্রসারের কাজে গভীরভাবে সম্পৃক্ত। ১৯৯৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারাভিযানে রিপাবলিকানরা অভিযোগ করে যে সংবাদপত্র ও ডেমোক্রেটরা ক্লিনটনের জীবন সহজতর করার জন্য গিংরিচের ব্যাপারটা জিইয়ে রাখছে। সহসা বড়দিনের প্রাক্কালে গিংরিচ নিজের স্পীকারের পদটি রক্ষা করার জন্য ইতোমধ্যে যা ক্ষতি হয়ে গেছে তা কমানোর সিদ্ধান্ত নেন। লক্ষ্য করে থাকবেন তিনি কোন আইন লঙ্ঘনের কথা স্বীকার করেননি। স্রেফ বলেছেন যে, তিনি যাতে কোন আইন লঙ্ঘন না করেন তা ‘নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছেন।’ আমিই কি একমাত্র ব্যক্তি যে মনে করে স্বীকারোক্তি করার সময়ও গিংরিচ মিথ্যা কথা বলেছেন? গিংরিচের ব্যাপারে কথার কারসাজি এমন সুচতুরভাবে ও সাফল্যের সঙ্গে করা হয়েছে যে আমার মনে হয়েছে গিংরিচ অন্তত কিছুকালের জন্য হলেও পার পেয়ে যাবেন। মিথ্যাচারের অপর যে কাহিনীটি আমাদের পত্রিকাগুলোর প্রথম পৃষ্ঠায় একইভাবে প্রাধান্য বিস্তার করেছে তা হলো ডেমোক্রেট দলের জাতীয় দলের তহবিল সংগ্রহের ঘটনা। সত্যের সন্ধানে নিয়োজিত জনসাধারণ ও সংবাদপত্র যেসব সমস্যার সম্মুখীন তা ব্যাখ্যা করার জন্য এটাই এখন আমার পছন্দের বিষয়। আইনে আছে যে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক প্রচারকার্যে অমার্কিন নাগরিক ও কোম্পানিগুলো অর্থ যোগাতে পারবে না। এই নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও বিদেশীরা ক্লিনটনের প্রচারাভিযানে লাখ লাখ ডলার যুগিয়েছিল। এদের প্রচার কাজে নিয়োজিত চিত্রবিচিত্র পোশাকধারী ক্রু বলে চালানো হলেও কখনও তাদের আসল পরিচয় ব্যাখ্যা করা হয়নি। প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের কাছে এই দাতাদের যাতায়াতের অসাধারণ সুযোগ ছিল। বেশ কয়েক লাখ ডলারের প্রশ্নসাপেক্ষ চাঁদা দেয়া নিয়ে আলোচনার জন্য ১৯৯৬ সালের ৯ মে ক্লিনটনের সিনিয়র সহকর্মী ও ক্লিনটন ডিফেন্স ফান্ডের সিনিয়র কর্মকর্তাদের মধ্যে যে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছিল সে সম্পর্কে সে বছরের ২২ ডিসেম্বর হোয়াইট হাউস থেকে তিনটি সুস্পষ্ট রকমের ভিন্ন ভিন্ন ভাষ্য দেয়া হয়। রিপোর্টারদের যাঁরা এই ভাষ্যটা গ্রহণ করেন তাঁরা বাহ্যত মিথ্যাচার করেছিলেন। কারণ পরবর্তী ভাষ্যতে উল্লেখ করা হয় যে কেউ কিছুই রাখার কথা বলেননি। সহকর্মীরা স্রেফ প্রশ্ন তুলেছিলেন। যে প্রশ্নগুলো তোলা হয়েছিল সেগুলো ছিল এই অর্থ যে ফেরত দেয়া হচ্ছে দাতা ও জনসাধারণের কাছে তা কিভাবে ব্যাখ্যা করা যায় শুধুমাত্র সেই সম্পর্কিত। অর্থটা জুন মাসের শেষদিকে ফেরত দেয়া হয়। ফেরত দেয়ার সময় একটা চিঠিও দেয়া হয় যাতে উল্লেখ ছিল : ‘তার মানে এই নয় যে সংযোজিত তথ্য শিটে বর্ণিত শর্তাবলী পূরণ করলে আপনারা চাঁদা দিতে পারবেন না। এই চিঠি থেকে আরও ১ লাখ ২০ হাজার ডলার বেরিয়ে আসে। তবে পরবর্তী তদন্তে দেখা যায় যে সেই অর্থের কিছু অংশ এসেছিল এমন লোকজনের কাছ থেকে যাদের দেয়ার মতো অর্থ সম্পদ ছিল না এবং বাকি অংশ এসেছিল অন্যান্য সূত্র থেকে। বলাবাহুল্য, এই পরবর্তী তদন্তের সূত্রপাত ঘটিয়েছিল রিপোর্টাররা যারা ভেবেছিল যে সত্য এখনও পর্যন্ত উন্মোচিত হয়নি। সত্যটা কোথায়? সেটাই হলো প্রশ্ন যা আমাদের এই পেশায় টেনে এনেছে যেমন তা ডায়োজিনিসকে এ্যাথেন্সের রাস্তায় রাস্তায় সৎ মানুষের খোঁজে চালিত করেছিল। আমাদের সত্যের সন্ধান যত বেশি আক্রমণাত্মক ততই কিছু লোক সংবাদপত্রের কারণে ক্ষুব্ধ বা কুপিত হয়। ইস্যুগুলো যত বেশি জটিল হয় সত্যকে আড়াল করার কৌশলগুলো তত বেশি পরিশীলিত রূপ ধারণ করে। আমাদের সত্যের সন্ধান যত বেশি মারমুখী হয়ে উঠবে ততই কিছু লোকের কাছে আমরা নিশ্চিতরূপে অধিকতর আক্রমণাত্মক হয়ে উঠব। মনে রাখবেন বহু বছর আগে ওয়াল্টার লিপম্যান সঠিকভাবেই লিখেছিলেন যে, গণতন্ত্রে সত্য এবং কেবলমাত্র সত্যই কদাচিত তাৎক্ষণিকরূপে পাওয়া যায়। গণতন্ত্রে সত্য আবির্ভূত হয় এবং কখনও কখনও তার জন্য বেশ কয়েক বছর লেগে যেতে পারে। আর এভাবেই এ ব্যবস্থাটির কাজ করার এবং শেষ পর্যন্ত নিজে নিজে জোরদার হয়ে ওঠার কথা। আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে জানি যে সত্য উন্মোচিত হয় বা বেরিয়ে আসে। এই বোধ থেকে আমি এখন বিরাট শক্তিলাভ করি। কখনও কখনও সত্য উন্মোচিত হতে চিরটাকাল লেগে যায়। তথাপি তা উন্মোচিত হয়। আর সত্য উন্মোচনে সংবাদপত্রের যে কোন ধরনের শৈথিল্যের জন্য গণতন্ত্রকে অত্যন্ত চড়া মাসুল দিতে হয়। সূত্র : ওয়াশিংটন পোস্ট
×