ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

শিক্ষা ক্যাডারে পদায়ন নিয়ে তুঘলকি, লাভবান হলো কারা

প্রকাশিত: ০৪:৫৫, ১১ নভেম্বর ২০১৪

শিক্ষা ক্যাডারে পদায়ন নিয়ে তুঘলকি, লাভবান হলো কারা

বিভাষ বাড়ৈ ॥ পদোন্নতি দিয়ে অভিনন্দন পেলেও শিক্ষা ক্যাডারে উল্টাপাল্টা পদায়ন দিয়ে তুঘলকি কা- ঘটিয়ে ফেলেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা অধিদফতর। পদোন্নতির পর সাবেক ছাত্রলীগ নেতাসহ প্রগতিশীল শিক্ষক কর্মকর্তাদের গণহারে ঢাকার বাইরে বদলি আর বিএনপি-জামায়াতপন্থীদের বদলি না করে স্বপদে ঢাকাতেই রাখার গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। ছাত্রদল-শিবিরের সাবেক নেতাদের কাউকেই বদলি হতে হয়নি। এখানেই শেষ নয়, অসংখ্য প্রগতিশীল নিরীহ সাধারণ শিক্ষককে নিজ কলেজ বা পার্শ্ববর্তী কলেজে পদ শূন্য থাকার পরও হয়রানিমূলকভাবে দূর-দূরান্তে দুর্গম স্থানে বদলি করা হয়েছে। পার্শ্ববর্তী ও স্ব-স্ব কলেজে পদ খালি থাকলেও দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে নারী শিক্ষকদেরও। পুরো ঘটনা নিয়ে অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়েছে দেশের সরকারী কলেজসহ পুরো শিক্ষা ক্যাডারে। এদিকে ঘটনার জন্য শিক্ষা অধিদফতরের উর্ধতন কর্মকর্তা ও মন্ত্রণালয়কে দায়ী করে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছেন ক্ষুব্ধ ছাত্রলীগ নেতারা। তাঁরা বলেছেন, আমলাদের কবলে পড়ে পদায়ন নিয়ে হয়রানির শিকার হয়েছেন শিক্ষা ক্যাডারে থাকা সাবেক ছাত্রলীগ নেতারা। উদ্দেশ্যমূলকভাবে বদলি হওয়া ছাত্রলীগসহ প্রগতিশীল প্রতিক্রিয়াশীলদের নাম পরিচয় উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে অভিযোগ করা হয়েছে। ‘শিক্ষা ক্যাডারে কর্মরত ছাত্রলীগের সাবেক নেতৃবৃন্দকে একযোগে ঢাকার বাইরে বদলি ও ছাত্রশিবিরের নেতাদের ঢাকায় পদায়ন’ শিরোনামে তালিকা প্রকাশ করে অবিলম্বে মন্ত্রণালয়ে থাকা ষড়যন্ত্রকারীদের চিহ্নিত করার আহ্বান জানানো হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কাছে। বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে এক হাজার ৬৮৮ জন শিক্ষকের পদোন্নতি দিয়েছে সরকার। তাদের মধ্যে এক হাজার ৪৫ জনকে প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক পদে এবং ৬৪৩ জন সহকারী অধ্যাপক থেকে সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পেয়েছেন। এর আগে গত ৮ নবেম্বর সন্ধ্যায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপসচিব বেলায়েত হোসেন তালুকদার স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপন জারি হয়। এতে বলা হয়েছে, পদোন্নতিপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা আগামী ১৩ নবেম্বর মধ্যে বর্তমান কর্মস্থল থেকে অবমুক্ত হবেন। অন্যথায় ওই দিন অপরাহ্ণ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে অবমুক্ত মর্মে গণ্য হবে। ১৩ অক্টোবর রাতে ৩৬৭ জন সহযোগী অধ্যাপককে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। সবমিলিয়ে এবার দুই দাপে মোট দুই হাজার ৫৫ জন কলেজ শিক্ষক পদোন্নতি পেয়েছেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানায়, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এবারই সবচেয়ে বেশি সংখ্যক কলেজ শিক্ষক পদোন্নতি পেয়েছেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, শিক্ষা ক্যাডারে গত বছরের ১৩ মে এক সঙ্গে এক হাজার ৬৩২ জন কলেজ শিক্ষককে পদোন্নতি দেয়া হয়েছিল। এর আগে ২০০১ সালের জুলাইয়ে এক সঙ্গে প্রায় আড়াই হাজার শিক্ষা ক্যাডারের সদস্য পদোন্নতি পেয়েছিল। দেশের ৩০৬টি সরকারী কলেজ এবং শিক্ষা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা ক্যাডারে মোট শিক্ষকের পদ রয়েছে ১৫ হাজার ১১২টি। তবে বড় পদোন্নতি দিয়ে মন্ত্রণালয় অভিনন্দন কুড়ালেও পদায়ন নিয়ে গোলমেলে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। প্রশ্নের মুখে পড়েছে মন্ত্রণালয় ও অধিদফতর। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, শিক্ষকদের আবেদন ও কলেজের শূন্যপদ বিবেচনায় না নিয়ে শিক্ষা অধিদফতরের প্রভাবশালী কর্তা ব্যক্তি ও আমলারা নিজেদের ইচ্ছেমতো পদায়ন করায় এ নৈরাজ্যের সৃষ্টি হয়েছে। এতে সবচেয়ে বেশি হয়রানির শিকার হয়েছেন প্রগতিশীল, নারী ও অসুস্থ শিক্ষকরা। প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদায়নে অনিয়মের অভিযোগ তুলে যে তালিকা জমা দেয়া হয়েছে তাতে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, ‘বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারে কর্মরত ছাত্রলীগের সাবেক নেতৃবৃন্দকে একযোগে ঢাকার বাহিরে বদলি ও পদায়ন করা হয়েছে।’ বলা হয়েছে, শিক্ষা অধিদফতরের আইন কর্মকর্তা ছিলেন আব্দুস সালাম। ছাত্রজীবনে ছিলেন ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি জসিমউদ্দীন হল শাখার সহসভাপতি। দক্ষ কর্মকর্তা হিসেবে সুনাম থাকলেও তাকে বদলি করা হয়েছে হবিগঞ্জের বৃন্দাবন কলেজে। মুহাম্মদ মনিরুল আলম (মাসুম) ছিলেন রাজধানীর সরকারী বাংলা কলেজে। ছাত্রজীবনে ছিলেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সদস্য। ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য় ছাত্রলীগের শিক্ষা ও পাঠচক্র সম্পাদক ও এসএম হল শাখার যুগ্ম-সম্পাদক। তকে বদলি করা হয়েছে ফরিদপুরের সরকারী রাজেন্দ্র কলেজে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবে সহসভাপতি প্রলয় দাস (চয়ন) কর্মরত ছিলেন ঢাকা কলেজে। তকে বদলি করা হয়েছে মাদারীপুরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হল শাখা ছাত্রলীগের সাবেক-সহসভাপতি মোঃ ওবায়দুল করিম কর্মরত ছিলেন ঢাকা কলেজে। বদলি করা হয়েছে পিরোজপুর সরকারী সোহরাওয়ার্দী কলেজে। মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন কর্মরত ছিলেন রাজধানীর সরকারী তিতুমীর কলেজে। ছাত্রজীবনে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বঙ্গবন্ধু হল শাখা ছাত্রলীগের যুগ্মসম্পাদক। তাকে বদলি করা হয়েছে ভোলা সরকারী মহিলা কলেজে। বিজয় কুমার ঘোষ ছিলেন শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরের উপ-পরিচালক। ছাত্রজীবনে ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের মতিহার হলের সভাপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংগঠনিক সম্পাদক। তাকে বদলি করা হয়েছে পাবনা এ্যাডওয়ার্ড কলেজে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদফতর থেকে ছিলেন বিপুল চন্দ্র সরকারকে বদলি করা হয়েছে পটুয়াখালী সরকারী কলেজে। তিনি ছিলেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা ও জগন্নাথ হল শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক। প্রধানমন্ত্রীর কাছে জমা দেয়া অভিযোগনামায় আছে আরও বেশ কয়েকজন প্রগতিশীল শিক্ষক। আছেন কয়েকজন নারী শিক্ষকও। আরও হয়রানির ভয়ে অনেকে নাম প্রকাশ না করার জন্য সাংবাদিকদের কাছে অনুরোধ করেছেন। ঢাকার পার্শবর্তী বেশ কয়েকটি কলেজ থেকে নারীদের বদলি করা হয়েছে দূরান্তে। অথচ স্ব-স্ব কলেজ ও পাশের কলেজেই পদ শূন্য ছিল। এক শিক্ষকের কিডনি অপারেশনের পর গুরুতর অসুস্থতার মধ্যেই সম্প্রতি ঢাকা থেকে মাদারীপুরে বদলি করা হয়েছিল। মানবিক আবেদনের পর গত সপ্তাহে তাকে ঢাকার তিতুমীর কলেজে নিয়ে আসে মন্ত্রণালয়। কিন্তু আসার এক দিনের মাথায় আবার তাকে বদলি করে দেয়া হয়েছে অসুস্থতার মধ্যেই। প্রধানমন্ত্রীর কছে বিক্ষুব্ধ শিক্ষকরা জমা দিয়েছেন ঢাকায় পদায়ন করা ছাত্রশিবির ও ছাত্রদলের নেতাদের নামের তালিকাও। অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, এসএম কামাল হায়দার অধিদফতরের মহাপরিচালকের আস্থাভাজন হওয়ায় পদোন্নতির পরও বদলি হতে হয়নি। অধিদফতরের সহকারী পরিচালক (কলেজ-২) পদেই বহাল আছেন তিনি। অথচ কামাল হায়দার ছিলেন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকালের আমলে শিক্ষা বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সভাপতি বিএনপি নেতা সামসুল আলম প্রামাণিকের পিএস এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় নেতা। সহকারী পরিচালক (কলেজ-১) পদে বহাল রাখার অভিযোগ আনা হয়েছে মোহাম্মদ তাজিব উদ্দিনের বিষয়ে। বলা হয়েছে, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এসএম হল শাখা ছাত্রদলের নেতা। বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র মজিবর রহমান সরোয়ারের সাবেক পিএস এবং ছাত্রদল নেতা ছিলেন মোঃ নজরুল ইসলাম। পদোন্নতির পরেও তিনি ঢাকাতেই আছেন বলে অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে। আরও বলা হয়েছে মোঃ মাহাবুব হোসেন ছিলেন ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা। পদোন্নতির পর তাকেও ঢাকার বাইরে যেতে হয়নি। ড. মোঃ মোরশীদুল হাসানের বিষয়ে তালিকায় বলা হয়েছে, তিনি ছিলেন ঢাকা মহানগর জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খানের একান্ত সহকারী এবং ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা । অধিদফতর থেকে তাকেও বদলি হয়ে হয়নি। সাবেক ছাত্রদল নেত্রী প্রিম রিজভীকেও অধিদফতর থেকে কোথাও যেতে হয়নি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিবিরের নেতা মোহাম্মদ সলিম উল্লাহকে বদলি হতে হয়নি কর্মস্থল ব্যানবেইস থেকে। রাজধানীর কবি নজরুল কলেজে নিজের এক আত্মীয়কে রাখার অনুরোধ করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তা। কিন্তু কোন লাভ হয়নি। সেখানে পদায়ন করা হয়েছে বিসিএস শিক্ষা সমিতির এক প্রভাবশালী ব্যক্তির আত্মীয়কে। যার সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামীর পরিবারের। অবিবেচক এই পদায়ন বাতিল ও পুনর্বিবেচনার জন্য শিক্ষকদের শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরে ভিড় করতে দেখা যাচ্ছে। এদিকে শিক্ষামন্ত্রী এই মুহূর্তে দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। কয়েকবার চেষ্টা করেও শিক্ষা সচিব নজরুল ইসলাম খানের বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি। অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ফাহিমা খাতুন অসুস্থ থাকায় কথা বলতে রাজি হননি। সোমবার মন্ত্রণালয়ে এসে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ছাত্রলীগের সাবেক কয়েক নেতাও। একজন বললেন, আমার বোনকে ঢাকা থেকে বদলি করে এক শ’ মাইল দূরে পাঠানো হয়েছে। যেন ছাত্রলীগ করে আমি অপরাধ করেছি।
×