ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রূপকথার নায়ক সাকিব

প্রকাশিত: ০৫:০৯, ৯ নভেম্বর ২০১৪

রূপকথার নায়ক সাকিব

মোঃ মামুন রশীদ ॥ টেস্ট অলরাউন্ডার হিসেবে যখন এক নম্বরে উঠে এসেছেন তখন থেকে আর সহজে কেউ নামাতে পারেনি সাকিব আল হাসানকে। বিশেষ করে তারপর নিয়মিত খেলেছেন অথচ তাঁকে কেউ টপকেছেন এমনটা দেখা যায়নি। তবে অনেকবারই ইনজুরির কারণে খেলতে পারেননি, টেস্ট ক্রিকেটের নবীনতম সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ দলও খুব কম খেলার সুযোগ পায়। তাই বেশ কয়েকবার তাঁকে টপকে শীর্ষস্থান জয় করেছে বিশ্বের অন্য অলরাউন্ডাররা। তবে এতসব সীমাবদ্ধতাকে জয় করেও বিশ্বসেরা টেস্ট অলরাউন্ডারের খেতাবটা পুনরুদ্ধার করেছেন তিনি। আবারও বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার হয়ে উঠতে তিনি অসামান্য এক কীর্তিই গড়েছেন সফরকারী জিম্বাবুইয়ের বিরুদ্ধে। অলরাউন্ড নৈপুণ্যে যা করেছেন সেটা ১৩৭ বছরের টেস্ট ক্রিকেট ইতিহাসে মাত্র দু’জন করে দেখাতে পেরেছিলেন। ইমরান খান ও ইয়ান বোথাম। একই টেস্টে সেঞ্চুরি এবং বল হাতে ১০ উইকেট। বেদখল হয়ে যাওয়া সিংহাসন ফিরে পেতে এর চেয়ে বিরল রেকর্ড আর কিছু কি হতে পারে? অথচ খুলনা টেস্টের আগেও র‌্যাঙ্কিংয়ে সবার নিচে ছিল বাংলাদেশ। টেস্ট ক্রিকেটের মর্যাদাটাও বার বার কেড়ে নেয়ার হুমকি এসেছে। সেই দেশের জন্য একজনই যথেষ্ট মর্যাদা অটুট রাখতে। তিনি সাকিব। সত্যি রূপকথার নায়ক তিনি, যেন পক্সক্ষীরাজে সওয়ার হয়ে স্বর্গ থেকে নেমে এসেছেন মর্ত্য।ে টেস্ট খেলার যোগ্যতা রাখে না বাংলাদেশ। ভুলক্রমে দেয়া হয়েছে টেস্ট খেলার মর্যাদা। খেতাবটা কেড়ে নিয়ে দিয়ে দেয়া উচিত আফগানিস্তান কিংবা অন্য কোন দেশকে। এসব টুকরো টুকরো কথা তীরের মতো বার বার বিদ্ধ করেছে বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষকে। এ দেশের মানুষ ক্রিকেটের জন্য কতটা পাগল সেটা বারবারই প্রমাণিত হয়েছে। সুখে-দুঃখে দেশের ক্রিকেটারদের পাশেই থেকেছে। গত প্রায় একটা বছরই গেছে চরম ভোগান্তির মধ্যে। তবে ক্রিকেট দলের ব্যর্থতার জন্য কেউ ক্ষোভ প্রকাশ করেননি। অথচ ক্রিকেটারদের পক্ষেই এর মাঝে বিক্ষোভ করেছেন দেশের ক্রিকেটপ্রেমীরা। আর সাকিব যখনই মাঠে নেমেছেন পুরো মাঠই তাঁর হয়ে কথা বলেছে। কারণ ব্যাট ও বল দুটিই হাতে নিয়ে তিনি বাংলাদেশকে অন্য প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে গর্ব এনে দিয়েছেন অনেক বার। ২০০৯ সালে বাংলাদেশের প্রথম বিদেশের মাটিতে টেস্ট সিরিজ জয়ের নায়ক ছিলেন সাকিব। এরপর থেকেই সাকিব এক ভয়ের নাম যে কোন প্রতিপক্ষের জন্য। ধারাবাহিকভাবেই ভাল করে গেছেন ব্যাট ও বল হাতে। তাঁরই পুরস্কার স্বরূপ ২০১১ সালের ডিসেম্বরে টেস্ট অলরাউন্ডার র‌্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষে ওঠেন প্রথমবার। এরপর এক থেকে তিনে বেশ কয়েকবার ওঠানামা করেছেন নিয়মিত খেলতে না পারার কারণে। যখনই খেলেছেন, পুনরুদ্ধার করেছেন হারানো আসন। আবারও করলেন। সবার অনুমিতই ছিল জিম্বাবুইয়ের বিরুদ্ধে প্রত্যাবর্তনের সিরিজে দারুণ কিছু করবেন। সেটাই করেছেন ৪১৯ রেটিং নিয়ে তিনিই এখন শীর্ষে। দুইয়ে নেমে যাওয়া ভারতের রবিচন্দ্রন আশ্বিন অনেকটাই পিছিয়ে ৩৫৭ রেটিং নিয়ে। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) থেকে নিষেধাজ্ঞা থাকায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে যেতে পারেননি। তাই রাজার বিলম্ব হয়েছে সিংহাসনে নতুন করে বসতে। জিম্বাবুইয়ের বিরুদ্ধে প্রথম টেস্টেই ফিরলেন আবার। আর ওই ম্যাচে ব্যাট হাতে তেমন কিছু করতে না পারলেও দুই ইনিংসে নিলেন ৭ উইকেট। তিন বল হাতে নেয়ার সঙ্গেই সঙ্গেই স্টেডিয়াম পাড়ায় ‘সাকিব-সাকিব’ ধ্বনি আছড়ে পড়েছে কংক্রিটের প্রতিটি আস্তরণের বিন্দুতে বিন্দুতে। সেটার প্রতিদানও দিয়েছেন। আর দর্শক-ভক্ত ও দেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের চাওয়াটা পূর্ণ করতে পারেন বলেই সবার হৃদয়ে ঠাঁই করে নিয়েছেন তিনি। ব্যক্তি জীবনে কি করেছেন সেসব গৌণ। বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের নামটাকে উজ্জ্বল করা, ক্রিকেট বিশ্বে তাঁর সব কীর্তির জন্যই বার বার দেশের নাম উচ্চারিত হওয়ার পেছনে তো তিনিই। গর্ব নিয়ে তাই পতাকাটা যেকোন ভূ-খ-ে উড়তে পারে পতপত করে। ২০১১ সালের শুরু থেকে বাংলাদেশ যত টেস্ট খেলেছে এর মধ্যে সাকিব একাই বল হাতে ৩১ শতাংশ উইকেট এবং ১৬ শতাংশ রান করেছেন মোট দলীয় সংগ্রহের। মাত্র ৩৬ টেস্টে দু’বার তিনি সেঞ্চুরি এবং ইনিংসে পাঁচ উইকেট নেয়ার অসামান্য কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। যা এর আগে শুধু গ্যারি সোবার্স, মুশতাক মুহাম্মদ ও জ্যাক ক্যালিস করতে পেরেছিলেন। পারেননি কপিল দেব, ইয়ান বোথাম কিংবা রিচার্ড হ্যাডলিরা। আবার একই টেস্টে সেঞ্চুরির পর বল হাতে ১০ উইকেট শিকারের কৃতিত্ব শুধু ছিল পাক গ্রেট ইমরান খান ও ইংলিশ অলরাউন্ডার বোথামের। এ দু’জনকেও ছুঁয়ে ফেললেন। ৮৭ টেস্টে বাংলাদেশের জয় মাত্র ৬টি। কিন্তু সাকিব যত ম্যাচ খেলেছেন, নিজে জিতেছেন, মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে ঠাঁই করে নিয়েছেন তাঁদের মনে। সাকিব যে ৩৬ টেস্ট খেলেছেন তাঁর মধ্যে দল জিতেছে ৫ টেস্ট। সেই ৫ টেস্টে তিনি ৩৪ উইকেট নিয়েছেন ১৭.৩২ গড়ে (৪ বার ইনিংসে পাঁচ উইকেট) আর ৫১.৩৩ গড়ে করেছেন একটি সেঞ্চুরিসহ ৪৬২ রান। অথচ তাঁর ক্যারিয়ারের বোলিং গড় ৩০.৯৪ এবং ব্যাটিং গড় ৩৮.১৪। এর অর্থ প্রতিটি টেস্ট জয়ের পেছনেই মূল ভূমিকায় ছিলেন সাকিব। ২০১১ সালের পর থেকে বিশ্ব ক্রিকেটে সাকিবসহ আর মাত্র দুজন পেরেছেন টেস্ট ক্রিকেটে ১ হাজার রান ও ৫০ উইকেট নিতে। সাকিব ১৫ টেস্টে ৬৪ উইকেট ও ১২৬২ রান করে শীর্ষে। স্টুয়ার্ট ব্রড ৪০ টেস্টে ১০৯৭ রান ও ১৬৫ উইকেট এবং ড্যারেন সামি ২৭ টেস্টে ১০২২ রান ও ৫৫ উইকেট নিয়েছেন। সত্যিই রূপকথাই রচনা করেছেন সাকিব টেস্ট ক্রিকেটে এখনও সংগ্রামী একটি দল বাংলাদেশের হয়ে খেলেও যা পারেননি শীর্ষ দলগুলোর বিশ্ব চমকানো ক্রিকেটাররাও।
×