ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

কামারুজ্জামানের এলাকা নীরব

প্রকাশিত: ০৫:০৪, ৭ নভেম্বর ২০১৪

কামারুজ্জামানের এলাকা নীরব

রফিকুল ইসলাম আধার, শেরপুর, ৬ নবেম্বর ॥ মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সুপ্রীমকোর্টের চূড়ান্ত রায়ে জামায়াতের সিনিয়র সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল, শীর্ষ বদর নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁসি বহাল থাকলেও তার নিজ এলাকা শেরপুরে একেবারেই নীরব জামায়াত নেতাকর্মীসহ সমর্থকরা। সোমবার সকালে রায় ঘোষণার পর থেকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত শহরের কোথাও দলের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি তো দূরের কথা, মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের টিকিটি পর্যন্ত দেখা যায়নি। অন্যদিকে নেতাকর্মী-সমর্থক থেকে শুরু করে তাঁর পরিবারের ঘনিষ্ঠজন এবং বিশেষ করে জামায়াত অধ্যুষিত বাজিতখিলা এলাকার মানুষজনসহ কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না কষ্ট বা আফসোসের সুর। পূর্বাপর অবস্থা ॥ ১৯৫২ সালের ৪ জুলাই শেরপুর সদর উপজেলার বাজিতখিলা ইউনিয়নের নিভৃত পল্লী কুমড়ি মুদিপাড়ায় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী পিতা ইনসান আলী সরকারের ঘরে জন্ম নেয়া মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ৫ ভাই ও ২ বোনের মধ্যে চতুর্থ। এলাকায় দলীয় নেতাকর্মীদের মাঝে তিনি ‘জামান সাব’ বা ‘জামান ভাই’ বলেই সমধিক পরিচিত। তাঁর স্কুলজীবন কাটে জেলা শহরের ঐতিহ্যবাহী জি কে পাইলট হাইস্কুলে। এরপর উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হন পার্শ্ববর্তী জামালপুর আশেক মাহমুদ কলেজে। ১৯৭১ সালে উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র থাকাবস্থায় কামারুজ্জামান জামায়াতে ইসলামীর তখনকার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের ময়মনসিংহ জেলার প্রধান বনে যান। মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর ২২ এপ্রিল পাকিস্তানী বাহিনীকে সহযোগিতা করতে জামালপুরের আশেক মাহমুদ কলেজের ইসলামী ছাত্রসংঘের বাছাই করা নেতাকর্মীদের নিয়ে তিনি গড়ে তোলেন আলবদর বাহিনী। ওই বাহিনী সে সময় ময়মনসিংহ, জামালপুর, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, শেরপুর ও টাঙ্গাইলে ব্যাপক যুদ্ধাপরাধ ঘটায়। জামালপুরে আলবদর বাহিনীর ৭টি ক্যাম্পের মধ্যে শেরপুরে সুরেন্দ্র মোহন সাহার বাড়ি দখল করে বানানো ক্যাম্পের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন কামারুজ্জামান। সে সময় বহু মানুষ হত্যা করা হয় ওই ক্যাম্পে। এছাড়া তাঁর প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ নেতৃত্বে সীমান্তবর্তী নালিতাবাড়ী উপজেলার সোহাগপুর গ্রামে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয় ১৮৭ জন গ্রামবাসীকে। সেইসঙ্গে পাশবিক নির্যাতন চালানো হয় গৃহবধূদের। স্বাধীনতার পরের বছর ময়মনসিংহের নাসিরাবাদ কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন কামারুজ্জামান। ১৯৭৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে মাস্টার্স পাস করার পর সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের আমলে ১৯৭৮-৭৯ সালে ইসলামী ছাত্রশিবিরের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৯ সালের অক্টোবরে কামারুজ্জামান মূল দল জামায়াতে ইসলামীতে যোগ দেন এবং ওই বছর ১৬ ডিসেম্বর রুকনের দায়িত্ব পান। ১৯৮২-১৯৮৩ সালে তিনি জামায়াতে ইসলামীর মুখপত্র দৈনিক সংগ্রামের নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্বেও ছিলেন। ১৯৯২ সাল থেকে তিনি দলে সহকারী সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্বে রয়েছেন। অর্থাৎ পঁচাত্তর পরবর্তী রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে অনুকূল পরিবেশে ধাপে ধাপে কেন্দ্রীয় শিবিরসহ জামায়াতের শীর্ষ নেতৃত্বে চলে যান কামারুজ্জামান। ওই অবস্থায় আন্তর্জাতিক লবিতে বিচরণ করে ইসলামী ব্যাংকের অংশীদারিত্বসহ প্রচুর বিত্তবৈভবের মালিক বনে যান তিনি। সেই সুবাদে জাতীয় নির্বাচনে ১৯৮৬ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত ৩ বার জামায়াতের ব্যানারে এবং ২ বার বিএনপির নেতৃত্বাধীন ৪ দলীয় জোটের ব্যানারসহ সর্বমোট ৫ বার শেরপুর-১ (সদর) আসন থেকে প্রার্থী হলেও প্রতিবারই শেরপুরবাসী তাঁকে প্রত্যাখ্যান করে। ২০০৮ সালে দ্বিতীয় দফায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার গঠিত হলে দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। ওই অবস্থায় ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে ২০১০ সালের ১৩ জুলাই কামারুজ্জামান হাইকোর্ট এলাকা থেকে গ্রেফতার হন। একই বছরের ২ আগস্ট তাঁকে গ্রেফতার দেখানো হয় একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায়। এরপর থেকে টানা দীর্ঘ সময় কারাগারে আটক এবং ২০১৩ সালের ৯ মে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মৃত্যুদ-ের রায় ঘোষিত হয়। চূড়ান্ত রায় পরবর্তী অবস্থা ॥ ওই রায়ের প্রেক্ষিতে জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মসূচীর অংশ হিসেবে দেশব্যাপী হরতালের ডাক দেয়া হলেও তাঁর নিজ নির্বাচনী এলাকা শেরপুরে তেমন কোন প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। সর্বশেষ ৩ নবেম্বর সোমবার উচ্চ আদালতে তাঁর করা আপীলে মৃত্যুদ- বহাল থাকায় শেরপুরে আওয়ামী লীগসহ মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের নেতাকর্মী ও সংগঠক এবং একাত্তরের শহীদদের স্বজন, মুক্তিযোদ্ধা ও সাক্ষীসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের মাঝে আনন্দ-উচ্ছ্বাসের বহিঃপ্রকাশ ঘটলেও গত ৪ দিনে দলীয় নেতাকর্মী-সমর্থক ও কামারুজ্জামানের আত্মীয়স্বজনদের মাঝে বিপরীত অনুভূতি প্রকাশের কোন চিহ্ন দেখা যায়নি। বৃহস্পতিবার বিকেলে কামারুজ্জামানের জন্মস্থান বাজিতখিলা এলাকা ঘুরে এমন চিত্রই পাওয়া যায়। কুমড়ি মুদিপাড়া গ্রামে কামারুজ্জামানের পৈত্রিক বাড়িতে বর্তমানে তাঁর বড় দুই ভাই বসবাস করছেন। বাড়িটি এখন পুলিশের পাহারায় রয়েছে। স্বজনদের প্রতিক্রিয়া ॥ চূড়ান্ত রায়ের পর মঙ্গলবার তাঁকে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে এনে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা হয়েছে। বিষয়টি জানার পরও কষ্ট বা দুঃখে তেমন ভারাক্রান্ত নন তাঁর স্বজনরাও। তবে রায়ের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে কামারুজ্জামানের বড় ভাই আলমাছ আলী বলেন, ‘আমার ভাইয়ের সুষ্ঠু বিচার হয় নাই। আমার ভাই কোন অপরাধ করে নাই, আমার ভাই নির্দোষ।’ আর কামারুজ্জামানের বোন আমেনা বেগম বলেন, ‘আমার ভাই কোন ঘটনার সঙ্গে জড়িত না। এগুলো সব মিথ্যা।’ ওই সময় দলের নেতৃস্থানীয় কাউকে না পেলেও এলাকার সাধারণ মানুষের মধ্যে অনেকেই তাঁর বিষয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার বিষয়টিও পাশ কেটে যান। দু’চারজন কথা বললেও নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, কৃতকর্মের ফল ভোগের ঘোষণা হয়েছে, তাতে কষ্ট বা দুঃখের কি আছে? আর কামারুজ্জামানের নিজ ইউনিয়ন বাজিতখিলার চেয়ারম্যান আব্দুল হান্নান বলেন, ‘এটা ভাল-মন্দ বিচারের বিষয় নয়। সর্বোচ্চ আদালতে যে রায় হয়েছে, তা আমাদের মেনে নিতেই হবে।’ নীরব-নিষ্ক্রিয় জামায়াত ॥ বার বার এ এলাকা থেকে কামারুজ্জামান জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থী হলেও এবং একটি পৌরসভাসহ ১৪টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত শেরপুর-১ (সদর) নির্বাচনী এলাকায় জামায়াতের বিশেষ অবস্থান থাকলেও তিনি গ্রেফতারের পর থেকেই স্থানীয়ভাবে জামায়াত মুখ থুবড়ে পড়েছে। দীর্ঘদিন থেকেই দলের জেলা আমির ও সেক্রেটারি জেনারেলের লাপাত্তাসহ সদর ও শহর ইউনিটের কোন কার্যক্রম বা তৎপরতা নেই। কোন কোন সময় বিশেষ ইস্যুর সুযোগে জামায়াত নেতাকর্মীরা সুকৌশলে কর্মসূচী হাতে নিলেও পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর বিশেষ তৎপরতার কারণে সেগুলোও ভেস্তে গেছে এবং আটক হয়েছে নেতাকর্মীদের একাংশ। যে কারণে ভগ্নদশা থেকে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি জামায়াত কিংবা ধরপাকড় এড়াতে মাঠে নামেনি তাদের নেতাকর্মীরা। আর সর্বশেষ চূড়ান্ত বিচারে ফাঁসি বহাল থাকায় কেন্দ্র ঘোষিত বুধবার ও বৃহস্পতিবারের ৪৮ ঘণ্টার হরতালে কোন প্রভাবই পড়েনি কামারুজ্জামানের নিজ এলাকা শেরপুরে।
×