ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

৮১ ॥ জেট ফুয়েল ওয়াগন নিয়ে বিপাকে রেল

প্রকাশিত: ০৫:০১, ৭ নভেম্বর ২০১৪

৮১ ॥ জেট ফুয়েল ওয়াগন নিয়ে বিপাকে রেল

মশিউর রহমান খান ॥ বাংলাদেশ বিমানের জেট ফুয়েল পরিবহনের জন্য কেনা ৮১টি ওয়াগন নিয়ে মহাবিপাকে পড়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় তেল পরিবহনের জন্য ভারত থেকে ৮৬ কোটি টাকা ব্যয়ে এগুলো কেনা হলেও শুধু বিমানের মজুদাগার (স্টোরেজ) ব্যবস্থা না থাকায় এসব ওয়াগন নিয়ে বিপাকে পড়েছে রেল কর্তৃপক্ষ। ফলে কেনার পর ১৬ মাস পার হলেও এখনও তা ব্যবহার করতে পারছে না রেলওয়ে। অযতœ আর অবহেলায় চট্টগ্রাম বন্দর ইয়ার্ডে ফেলে রাখা হয়েছে এসব ওয়াগন। ফলে ব্যবহারের আগেই শেষ হয়ে যাচ্ছে এসব ওয়াগণের ওয়ারেন্টির মেয়াদকাল। তেল পরিবহনের ব্যয় ও অপচয় কমানোর জন্য বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) ২০১০ সালে বাংলাদেশ রেলওয়ের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ভারতীয় রাষ্ট্রীয় ঋণে (এলওসি) ৮১টি মিটারগেজ তেলবাহী ওয়াগন সংগ্রহ করে রেলওয়ে। জানা গেছে, প্রতিটি ওয়াগনের ধারণক্ষমতা ৪০ টন বা ৪০ হাজার ৭৫০ লিটার। সংশ্লিষ্টরা জানান, একটি ট্রেনে সর্বোচ্চ তেলবাহী ৪০টি ওয়াগন পরিবহন করা যায়। এতে প্রতিট্রিপে ১ হাজার ৬০০ টন জেট ফুয়েল বহন করা সম্ভব হবে। সূত্রমতে, বিমানের দৈনিক ৮০০ থেকে ১ হাজার টন তেল হলেই চলে। এছাড়া সংস্থাটির মজুদক্ষমতাও বর্তমানে অনেক কম। জানা গেছে, বর্তমানে নৌপথে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত আনা হয় বিমানের জেট ফুয়েল। এরপর সড়কপথে ট্যাংক-লরির মাধ্যমে তা হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছে দেয়া হয়। এতে পরিবহন ব্যয় বাড়ার পাশাপাশি ট্রানশিপমেন্টে তেলের অপচয়ও হয়। ব্যয় ও অপচয় কমানোর জন্য বিপিসি রেলপথে জেট ফুয়েল পরিবহনের পরিকল্পনা নেয়। বিপিসির সঙ্গে রেলের চুক্তি অনুযায়ী, চট্টগ্রামে পদ্মা অয়েলের ডিপো থেকে ঢাকার বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন পর্যন্ত জেট ফুয়েল পরিবহন করবে রেলওয়ে। বিমানবন্দর স্টেশন থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত তেল পৌঁছানোর দায়িত্ব পদ্মা অয়েলের। এক্ষেত্রে জেট ফুয়েল খালাস করার জন্য রাজধানীর বিমানবন্দর রেলস্টেশনের পাশে সংরক্ষণাগার স্থাপনা ও সেখান থেকে বিমানবন্দরে তেল সরবরাহের পাইপলাইন নির্মাণ করবে বিপিসি। তবে সংরক্ষণাগার নির্মাণের জন্য নির্বাচিত স্থানটি আগেই র‌্যাব কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করেছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। র‌্যাবের প্রধান কার্যালয় এরই মধ্যে সেখানে নির্মাণ শুরু হয়েছে। ফলে জমি না পাওয়ায় সংরক্ষণাগার নির্মাণ করা যাচ্ছে না। এতে রেলপথে জেট ফুয়েল পরিবহন নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটছে না। এ বিষয়ে একাধিকবার আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক হলেও কোন সুরাহা হয়নি। বিপিসি সূত্র জানায়, বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা চলছে। বিকল্প হিসেবে সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে জেট ফুয়েল পরিবহনের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। আশা করা যায়, শীঘ্রই জটিলতা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে। রেলের পরিবহন বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, ভারত থেকে আমদানি করা ওয়াগনগুলোর প্রতিটির ধারণক্ষমতা ৪০ হাজার ৭৫০ লিটার। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা পর্যন্ত এ পরিমাণ জ্বালানি তেল পরিবহনে রেলওয়ের আয় হয় ৩৫ হাজার ৩৭৫ টাকা। সে হিসাবে ৮১টি ওয়াগনে তেল পরিবহন করে মাসে প্রায় ১ কোটি টাকা রেলওয়ের আয় হওয়ার কথা। ফলে গত ১৬ মাসে প্রায় ১৬ কোটি টাকা রাজস্ব হারিয়েছে রেলওয়ে। জানা গেছে, শুরুতে ঢাকা বিমানবন্দরে জেট ফুয়েল পাঠানোর কথা থাকলেও মজুদাগার নির্মাণে জটিলতায় সিলেট ওসমানী বিমানবন্দরে চট্টগ্রাম থেকে জেট ফুয়েল পরিবহনের চিন্তাভাবনা করে পদ্মা। এরই মধ্যে সিলেটে ফুয়েল রাখার জন্য মজুদাগার নির্মাণকাজ শেষ করে আনা হয়েছে। এছাড়া বেসরকারী বিদ্যুত প্লান্টে ফার্নেস অয়েল পরিবহনেও ওয়াগনগুলো ব্যবহারের পরিকল্পনা আছে। তবে জেট ফুয়েলের পরিবর্তে কেরোসিন, ডিজেল বা ফার্নেস অয়েল বহন করলে রেলের আয় কম হবে। রেলসূত্র জানায়, চুক্তি হলেও নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সাড়া না দেয়ায় রেলওয়ে বিকল্প চিন্তা করছে। এরই মধ্যে কুমিল্লার ময়নামতিতে স্থাপিত একটি পাওয়ার প্লান্টে বন্দর থেকে জ্বালানি পরিবহনের বিষয়ে রেলের প্রাথমিক আলোচনা চলছে। বিকল্প হিসেবে শিগগিরই ওয়াগনগুলো দিয়ে পাওয়ার প্লান্টসহ চাহিদা অনুযায়ী দেশের বিভিন্ন প্রান্তে জ্বালানি তেল পরিবহন শুরু করবে রেলওয়ে। উল্লেখ্য, বিপিসির সঙ্গে এমওইউর পরিপ্রেক্ষিতে ১০০টি মিটারগেজ ট্যাংক ওয়াগন ও ৫টি ব্রেকভ্যান সংগ্রহের প্রকল্প হাতে নেয় রেলওয়ে। এতে ব্যয় ধরা হয় ৭৭ কোটি টাকা। ২০১০ সালে প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) অনুমোদন করা হয়। তবে বেশি দামের কারণে প্রকল্পটি সংশোধন করে ৮১টি ওয়াগন ও ৩টি ব্রেকভ্যান কেনা হয়। ভারতের টেক্সমাকো ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড এগুলো সরবরাহ করে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মোট ব্যয় হয় ৮৬ কোটি টাকা। ২০১৩ সালের জুলাই-আগস্টে ট্যাংকারগুলো দেশে পৌঁছে। এগুলো ওয়ারেন্টির মেয়াদকাল শেষ হবে আগামী বছরের জুনে। তবে ব্যবহারের আগেই ওয়ারেন্টি শেষ হয়ে গেলে চলাচলের ক্ষেত্রে কোন সমস্যা হলে তার দায়দায়িত্ব নেবে না সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান টেক্সমাকো ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মোঃ তাফাজ্জল হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, জমি নিয়ে জটিলতার কারণে বিপিসি তেল খালাসের সংরক্ষণাগার করতে পারেনি। ফলে ওয়াগনগুলো ফেলে রেখেই ওয়ারেন্টির মেয়াদকাল শেষ করা যাচ্ছে। আমরা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করছি। কোন সমাধান করা না গেলে এসব ওয়াগন তেল পরিবহনের জন্য অন্যান্য খাতে ব্যবহার করার চিন্তা রয়েছে। তবে সিভিল এ্যাভিয়েশনের সহায়তা পেলে আশা করি মজুদাগারও নির্মাণ করা সম্ভব হবে। এতে চলমান সমস্যা দূর হবে। মজুদাগার নির্মাণ করা গেলে বিমানের জেট ফুয়েলের বর্তমান সমস্যা থাকবে না এবং সেই সঙ্গে রেলওয়ে লাভবান হবে।
×