ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ছুটির দিন ছাড়া রাজধানীতে সভা-সমাবেশ নয়

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ৬ নভেম্বর ২০১৪

ছুটির দিন ছাড়া রাজধানীতে সভা-সমাবেশ নয়

রাজন ভট্টাচার্য ॥ ছুটির দিন ছাড়া রাজধানীতে কোন সভা-সমাবেশ করতে না দেয়ার সরকারী পরিকল্পনা সব মহলেই প্রশংসিত হয়েছে। জনদুর্ভোগ কমাতে এই প্রক্রিয়াকে স্বাগত জানিয়েছেন সবাই। নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুক্র ও শনিবার সভা-সমাবেশের জন্য নির্দিষ্টস্থান ঠিক করে দেয়া হলে জনদুর্ভোগ কমবে। তবে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা আইন মেনে চললে রাজধানীর প্রায় ৪০ ভাগ যানজট নিরসন সম্ভব। পাশাপাশি যানজট কমাতে স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যান (এসটিপি) অনুযায়ী ছয়টি মেট্রোরেল লাইন স্থাপনসহ পর্যায়ক্রমে সকল পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা। এদিকে ছুটির দিন ছাড়া সভা-সমাবেশের অনুমতি নয় এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই সমাবেশ করতে হবেÑ আন্তঃ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এ প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য দ্রুতই পাঠানো হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর কাছে। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ছুটির দিন ছাড়া রাজধানীতে র‌্যালি, মিছিল ও সমাবেশ বন্ধ করা হচ্ছে। সমাবেশের জন্য সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে চারটি ভাগে ভাগ করা হবে। নির্ধারিত স্থান ছাড়া কোথাও সভা সমাবেশ করতে দেয়া হবে না। ঢাকা শহরের যানজট নিরসনে এই উদ্যোগের কথা ভাবছে সরকার। সম্প্রতি আরেক অনুষ্ঠানে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার বেনজীর আহমেদ বলেন, রাজধানীর যানজট পরিস্থিতি দিন দিন মারাত্মক আকার ধারণ করছে। এই প্রেক্ষাপটে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বাইরে সভা-সমাবেশের অনুমতি দেয়া হবে না। সরকার ও বিশ্বব্যাংক ২০০৯ সালে ‘ফাইনাল রিপোর্ট অন ক্লিন এয়ার এন্ড সাসটেইনেবল এনভায়রনমেন্ট’ প্রকাশ করে। সাম্প্রতিক এই প্রতিবেদনে বলা হয়, উত্তরা থেকে শুরু করে ঢাকা-ময়মনসিংহ রোড, প্রগতি সরণি, ডিআইটি রোড, টয়েনবি সার্কুলার রোড থেকে সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত, গাবতলী থেকে মিরপুর সড়ক, জহির রায়হান সরণি থেকে সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল পর্যন্ত এবং শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে এয়ারপোর্ট রোড, শহীদ তাজউদ্দীন সড়ক থেকে রমনা পর্যন্ত এলাকায়, ভোর ছয়টা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত যানজট পরিস্থিতি কেমন, তার একটি তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) হিসেব মতে, রাজধানীতে রেজিস্ট্রেশনভুক্ত পরিবহনের সংখ্যা আট লাখ ৩৫ হাজারের বেশি। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যানবাহনের সংখ্যা বাড়ছে। বাড়ছে মানুষ। সঙ্গত কারণেই ছুটির দিন ছাড়া রাজধানীতে সভা-সমাবেশ করা মানেই পুরো ঢাকা অচল হয়ে পড়া। বর্তমানে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অনুমতি নিয়ে যেখানে সেখানে সভা-সমাবেশের আয়োজন করা হচ্ছে। ক্ষমতাসীন দল হতে শুরু করে বিরোধী দলের পক্ষ থেকে রাস্তা আটকে আয়োজন করা হচ্ছে রাজনৈতিক কর্মসূচী। বিএনপি’র পক্ষ থেকে নয়াপল্টন এলাকায় রাস্তা বন্ধ করে রাজনৈতিক কর্মসূচী পালন করা হয়। এতে যানজট পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটের কারণে রাস্তায় যাত্রীদের দুর্ভোগ পোহাতে হয়। শুক্রবার এনটিভি ভবনে অগ্নিকা-ের পর দুই ঘণ্টারও কম সময়ে কাওরানবাজারের রাস্তাটি বন্ধ ছিল। ফলে রাজধানীজুড়ে যানজট ছড়িয়ে যায়। মধ্যরাত পর্যন্ত যানজট লেগেই থাকে। বাস্তবতা হলো, ঢাকায় চলাচলের মূল রাস্তা তিনটি। এরমধ্যে একটি কাওরানবাজারের রাস্তা, অপরটি মহাখালীর ও যাত্রাবাড়ী সড়ক। মৌচাক-মালিবাগ ফ্লাইওভার প্রকল্পের কারণে মহাখালীর রাস্তা দিয়ে এমনিতেই চলাচল করা খুবই কষ্টসাধ্য। এরমধ্যে রাস্তায় সভা সমাবেশ কিংবা ভিভিআইপি প্রটোকল মানেই যানজটের ভোগান্তি মধ্যরাত পর্যন্ত। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মিজানুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, বড় সিটির জন্য মোট আয়তনের ২০ ভাগ রাস্তা প্রয়োজন। ঢাকায় আছে ছয় থেকে আট ভাগ। এর মধ্যে চারভাগ রাস্তা ব্যবহার উপযোগী। যানজট পরিস্থিতি উন্নতির জন্য রাস্তা বাড়ানোর বিকল্প নেই। তিনি বলেন, ঢাকায় উত্তর ও দক্ষিণমুখী রাস্তা আরও বাড়াতে হবে। কারণ এই রুটে বেশিরভাগ যাত্রী চলাচল করেন। নগরীতে পূর্ব-পশ্চিমে রাস্তা নেই। রাজধানীর কলাবাগানে সকাল ছয়টা থেকে সাতটা পর্যন্ত দুই হাজার ৩৩৮ মানুষ চলাচল করে, সাতটা থেকে আটটায় এই সংখ্যা হয় পাঁচ হাজার ৩১৬ এবং আটটা থেকে ৯টা এই সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ১৪ হাজার ২৭৩। প্রায় একই চিত্র দেখা গেছে নগরীর বাণিজ্যিক জোন হিসেবে খ্যাত মতিঝিলে। এখানে সকাল ছয়টা থেকে সাতটায় আবদুল্লাহপুর থেকে প্রগতি সরণি হয়ে মতিঝিল পৌঁছান এক হাজার ৩০৪, সাতটা থেকে আটটায় পৌঁছান দুই হাজার ৩৫৮। আর আটটা থেকে নয়টা পর্যন্ত এই সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ১১ হাজার ৮৮৬ জনে। বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের সভাপতি মোবাশ্বের হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, রাস্তায় চলাচলে কেউ আইন মানেন না। আইনের প্রতি কারও তোয়াক্কা নেই। প্রধান বিচারপতির বাসভবনের সামনে দিয়ে উল্টো পথে সরকারের দায়িত্বশীল কর্তাব্যক্তিরা পর্যন্ত চলাচল করেন। যে কারণে যানজট থেকে আমাদের মুক্তি নেই। ছুটির দিন ছাড়া সভা-সমাবেশের অনুমতি দেয়া হবে না এমনকি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই সমাবেশ করতে হবে সরকারের এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বিশিষ্ট এই নগর পরিকল্পনাবিদ বলেন, যানজট নিরসনে এটি দ্রুত কার্যকর জরুরী। এ উদ্যোগ কিছুটা বাস্তবসম্মত। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ছুটির দিনে রাস্তায় গাড়ির চাপ কম থাকে। রাস্তায় চলাচলে পরিস্থিতি সহায়ক হয়। তিনি বলেন, এটি যানজট নিরসনে স্থায়ী কোন সমাধান নয়, মাথাব্যথা হলে প্যারাসিটামল খাওয়ার শামিল। উল্টোপথে গাড়ি চালিয়ে গেলেও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা কিছুই বলতে পারেন না। কারণ তারা প্রভাবশালী। বললে কিংবা আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হলে হয়ত পুলিশের চাকরি থাকবে না। প্রধানমন্ত্রীর অফিসের সামনে দিয়ে আইন ভঙ্গ করে গাড়ি চলতে দেখা যায়। অথচ ক্যান্টনমেন্টে গিয়েই সবাই আইন মেনে গাড়ি চালান। যানজট নিরসনে এসটিপির নির্দেশনা অনুযায়ী পর্যায়ক্রমে সকল পরামর্শ বাস্তবায়নের দাবি জানান তিনি। সম্প্রতি ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন অব বাংলাদেশের (আইইবি) পুরকৌশল বিভাগের গবেষণায় বলা হয়েছে, সমন্বিত গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় যানজট। গবেষণায় দেখা গেছে, এই মহানগরীতে ট্রাফিক জ্যামের কারণে বছরে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ২৭ হাজার কোটি টাকার বেশি। যাত্রীদের ক্ষেত্রে যা ১২ হাজার কোটি, ব্যবসা-শিল্প ও রফতানিবাণিজ্যের ক্ষেত্রে ৪ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া পরিবেশগত ক্ষতি দুই হাজার ৫শ’ কোটি টাকা। জ্বালানি, দুর্ঘটনা ও মেডিক্যালসহ বিভিন্ন খাতে বাকি অর্থ অপচয় হয়ে থাকে। মহানগরীতে যানজটের কারণে প্রতিদিন ৩২ লাখ ঘণ্টা বাণিজ্যিক সময় (বিজনেস আওয়ার) নষ্ট হচ্ছে। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের সদস্যসচিব স্থপতি ইকবাল হাবীব বলেন, ঢাকার জন্য যে বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা করা হয়েছে, সেখানে কোথায় কোন ধরনের প্রতিষ্ঠান কতটি থাকতে হবে, সে সম্পর্কে বলা আছে। এ আইন এখন কেউ মানে না। এ আইন অমান্য করার প্রবণতা শতভাগ। ফুটপাথ ও রাস্তা দখলমুক্ত রাখা, আইন মেনে চলছে যানজট পরিস্থিতি অনেকটাই সহনীয় পর্যায়ে আনা সম্ভব। ২০০৯ সালে রাজধানীর দুঃসহ যানজট নিরসনে সুনির্দিষ্ট পাঁচটি পদক্ষেপ বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে নগরীর কোন স্কুলের সামনে গাড়ি পার্কিং করা যাবে না। নিজস্ব বাস সার্ভিসের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের আনা-নেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। স্কুল জোন স্থাপনের পাশাপাশি ঢাকা ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের রাস্তাগুলো যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা হবে। ঢাকার যানজট পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকার সরকারী-আধা সরকারী অফিসে নতুন সময়সূচী চালু করে। একই বছরের ১ নবেম্বর থেকে স্কুল ও কলেজের সময়সূচীতে পরিবর্তন আনা হয়েছে। কিন্তু এরপরও যানজট খুব একটা নিয়ন্ত্রণে আসেনি। নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্কুলে শিক্ষার্থী আনা-নেয়ার যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে যানজট অনেকাংশে কমে আসবে। তাছাড়া যানজট নিয়ন্ত্রণে টাইমার কাউন্ট, সব সময় রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি না করাসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হলেও এর কোনটিই কার্যকর হয়নি। সঙ্গত কারণেই যানজট রয়েই গেছে।
×