ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

কি থাকছে শচীনের আত্মজীবনীতে

প্রকাশিত: ০৩:৫৯, ৬ নভেম্বর ২০১৪

কি থাকছে শচীনের আত্মজীবনীতে

অনুবাদ : এনামুল হক ৬ নবেম্বর প্রকাশ হচ্ছে ক্রিকেট অধীশ্বর শচীন টেন্ডুলকরের আত্মজীবনী ‘প্লেয়িং ইট মাই ওয়ে’। টেন্ডুলকরের সৌভাগ্য যে, জীবন তাঁকে কখনই উচ্ছন্নে যাওয়ার কারণ ঘটায়নি। জীবনের যে পথ তিনি বেছে নিতে চেয়েছিলেন সেটা যেন নিয়তি নির্ধারিত। তিনি পিতামাতাকে ভালবেসেছেন, তাঁদের কথা শুনেছেন। তিনি নিজের ক্রিকেট ব্যাটটা সোজা করে ধরতে চেয়েছেন, তাঁর কোচকে ভক্তি শ্রদ্ধা করেছেন। যে মেয়েটিকে ভালভাসতেন তাকেই বিয়ে করেছেন এবং ঠিক দুটো সন্তানই নিয়েছেন। ব্যাটসম্যান হিসেবে তিনি দেখিয়েছেন যে, মর্মবস্তুর দিক দিয়ে স্টাইল হলো একান্তই সঠিকভাবে করা কোন এ্যাকশনÑ বড়রা যেভাবে করতে বলেন ঠিক সেভাবে করা। মানুষের সঙ্গে আচরণের সময় প্রায়শই তিনি শ্রদ্ধার পথটা বেছে নেন। বিনয়-নম্রতা হলো বুদ্ধিরই একটা রূপ। তবে ভৌত অভিপ্রকাশ হিসেবে ওটা হলো সাধারণ মানুষকে পুনঃ আশ্বস্ত করার একটা সস্তা কৌশল যে, তাদের সাধারণত করুণা করার বিষয় নয়। তাঁর মধ্যে বিনয়-নম্রতা একই সঙ্গে প্রজ্ঞা ও কৌশলের যুগপৎ সমাহার। তিনি তাঁর মনের কথা খুলে বলেছেন ঘরোয়াভাবে, টিমের সতীর্থদের কাছে। কিন্তু পাবলিকের কাছে নয়। তাদের কখনই তিনি তথ্যের অধিকার দেননি। তাঁর ভেতরে একটা ভয় কাজ করে, যে ভয়টা মানুষকে সত্য ও সুন্দর করে তোলে। তাঁর মধ্যে সেই ভয়টা আছে যে, লোকে মন্দ হিসেবে গণ্য করতে পারে। কেউ কেউ বলেন যে, তাঁর আত্মজীবনীর নাম হওয়া উচিত ছিল ‘মেমোয়েরস অব এ ডিসেন্ট ম্যান’। প্রায় পাঁচ বছর আগে রাজ থ্যাকারে ও তাঁর দল বলছিল যে মুম্বাই আগে হলো মহারাষ্ট্রের। কথাটার অর্থ যাই থাক ক্রীড়া সাংবাদিক অক্ষয় সাওয়াই এক সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে টেন্ডুলকরের অভিমত জানতে চেয়েছিলেন। টেন্ডুলকর বলেছিলেন, ‘মুম্বাই হলো ভারতের। আমি একজন মহারাষ্ট্রীয়। মহারাষ্ট্রীয় হতে পেরে আমি অত্যন্ত গর্বিত। তবে আমি একজন ভারতীয়।’ অন্য কথায় তিনি বলতে গেলে কিছুই বলেননি। তাঁর এ কথা বলার জন্যও তিনি দুঃখ করেছিলেন। পরে জানিয়েছিলেন যে, এই প্রশ্নে তিনি অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। এমন একজন সতর্ক ব্যক্তিত্ব আত্মজীবনীতে কি কথা বলতে পারেন? এই বইয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কেউই বইটির মোড়ক উন্মোচনের আগে তেমন কিছু বলছেন না। তবে আভাস পাওয়া গেছে যে বইয়ে ‘চাঞ্চল্যকর’ বিষয় আছে। বস্তুতপক্ষে একটা অনুচ্ছেদ ছিল যার জন্য প্রকাশকের আইনী দলটি বেশ ঘাবড়ে গিয়েছিল। তথাপি টেন্ডুলকর সেই অনুচ্ছেদটি রাখার জন্য চাপ দিয়েছিলেন এবং সবাইকে আশ্বস্ত করে বলেছিলেন যে তার বক্তব্যের সমর্থনে তাঁর কাছে সাক্ষ্যপ্রমাণ আছে। খেলোয়াড়ি দিনগুলোতে কখনও কখনও আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য কিংবা নির্দিষ্ট কোন অভিমত জানিয়ে দেয়ার জন্য তাঁকে মিডিয়ার কাছে যেতে হয়েছিল। কিন্তু যতবারই গিয়েছিলেন ততবারই মাত্রাতিরিক্ত মনোযোগ আকর্ষণ করেছিলেন যেটা তার মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল। ব্যাপারটা এমন যেন তিনি চেয়েছিলেন তাঁর ভাবনাগুলো ভৌত আকারে টিকে থাকুক। এবং ব্যাপক পরিসরে ছড়িয়ে না পড়ুক। একবার তিনি ‘আউটলুক’ পত্রিকায় এক সাক্ষাতকার দিয়েছিলেন। তখন তিনি জোর করেছিলেন যে, সাক্ষাতকারের প্রসঙ্গটা ‘আউটলুকের’ প্রচ্ছদে উল্লেখ থাকবে না এটা যেন নিশ্চিত করা হয়। তার অনুরোধ ছিল এটা যেন ভেতরের কোথাও দেয়া হয় এবং ছোট করে দেয়া হয়। বইয়ে ক্রিকেটের বিষয়ে প্রচুর বিশ্লেষণ আছে বলে শোনা যায়। কিন্তু ক্রিকেটের বিশ্লেষণের চেয়ে পাঠকের কাছে বেশি আকর্ষণীয় হবে তিনি কি ধরনের গোপন ও চিত্তাকর্ষক তথ্য তাদের কাছে পরিবেশন করছেন। কারণ ক্রিকেটের গত ২৫ বছরের ইতিহাসের একটা কালো অধ্যায়ও টেন্ডুলকরের ক্রিকেট ইতিহাসের সঙ্গে মিশে আছে যদিও সেই অধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত কোন সম্পৃক্ততা কখনই ছিল না। সেই তথ্যগুলো প্রকাশে তাঁর অনেক অসুবিধাও আছে। কারণ তিনি বিসিসিআইএর একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা যে বিসিসিআই নিজেও হলো আইসিসির একটা অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। তথাপি মনে রাখতে হবে যে টেন্ডুলকর অতিমানব কেউ নন। তিনি একজন মানুষ এবং মানুষ বলেই তাঁর কিছু বলার এবং নিজে যা জানেন অন্যদের সঙ্গে তার শেয়ার করার অপ্রতিরোধ্য তাগিদ আছে। মনে হয় টেন্ডুলকর সেগুলো প্রকাশ করার জন্য শেষ পর্যন্ত প্রস্তুত। কিন্তু ঠিক কোন ঘটনাগুলো তিনি প্রকাশ করবেন? তিনি কি ভারতীয় দলের দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের একটি দিনের বিস্তারিত বিবরণ দেবেন, যেদিন তিনি ঝড়ের বেগে মোহাম্মদ আজহারউদ্দীনের হোটেল কক্ষে ঢুকে বাজে খেলার জন্য তাঁর মুখোমুখি হয়েছিলেন? খেলোয়াড়, প্রশাসক ও গ্রন্থ প্রকাশকদের মধ্যে গোপন যোগসাজশ সম্পর্কে তিনি যা কিছু জানেন সবই কি পাঠকদের বলবেন? তিনি কি বলবেন বাল থ্যাকারে সম্পর্কে তাঁর মনোভাব কি ছিল? এই থ্যাকারে একবার টেন্ডুলকরকে প্রকাশ্যে ভর্ৎসনা করে বলেছিলেন যে, নিজের বিপুল সম্পদের একাংশ দান করে না দিয়ে তিনি বরং চ্যারিটি করার জন্য নিলামকে কাজে লাগাচ্ছেন। থ্যাকারের মুখ থেকে এমন কথা বেরিয়েছিল এটা ভারি অদ্ভুত ব্যাপার। কারণ চ্যারিটি সম্পর্কে কিংবা কষ্টার্জিত অর্থ সম্পর্কে তাঁর তেমন কিছুই জানা ছিল না। টেন্ডুলকর এসব বিষয়ে দু-একটা কথা বলবেন তেমন সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তবে মানসিক যন্ত্রণাপীড়িত ও নিরাপত্তাহীনতায় ভোগা একদা ভারতীয় দলের অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলী সম্পর্কে কিছু না বলে তিনি পারবেন না। অবশ্য নিজের অবস্থানকে ধরে রাখার জন্য গাঙ্গুলী যা যা করেছিলেন টেন্ডুলকর কি তা প্রকাশ করবেন? তাছাড়া আছেন রাহুল দ্রাবিড়। সেখানেও কিছু সমস্যা আছে। টেন্ডুলকর এবং দ্রাবিড়ের প্রতি সমাজের ভালবাসার মধ্যে পার্থক্য আছে। পার্থক্যের ভিত্তি হলো শ্রেণী। টেন্ডুলকরের কৌশল যেমন ছিল বিনয়-নম্রতা, দ্রাবিড়ের কৌশল তেমনি ছিল বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে কথাবার্তা বলা যা কিনা দৃশ্যত বইপুস্তক পাঠ থেকে অর্জিত। শহুরে সমাজের একটা অংশের দ্রাবিড়ের প্রতি নেহরুসুলভ ভক্তি শ্রদ্ধা ছিল। দ্রাবিড়ের বিব্রত হবার মতো অনেক কিছুই টেন্ডুলকরের জানা। তেমনি জানা ভাগ্যবিড়ম্বিত কোচ গ্রেগ চ্যাপেল সম্পর্কে। গ্রন্থ রচনায় যাঁরা সহযোগিতা করেছেন তাঁদের কাছে টেন্ডুলকর এসব নিয়ে অনেক কিছুই বলেছেন। তবে সম্ভবত তিনি এসবের কিছুই বইয়ের ভেতর রাখেননি। সবার ব্যগ্র কৌতূহল থাকবে টেন্ডুলকরের বইটি সম্পর্কে। কি আছে কি আছে এই ভাবনায় সবাই অস্থির থাকবেন। তথাপি ধরে নেয়া যেতে পারে ওতে এমন কিছুই থাকবে না যাতে চারদিক প্রকম্পিত হয়ে ওঠে, সর্বত্র সাড়া পড়ে যায়, ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম হয়। কারণ টেন্ডুলকর একজন বাকসংযত মানুষ হিসেবে পরিচিত যিনি বিতর্ক এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেন। ভারতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের অঙ্গনে কিছু বিতর্কিত ঘটনা ঘটেছে। সেগুলোর ব্যাপারে তিনি বছরের পর বছর ধরে নির্বিকার মৌনতা বজায় রেখেছেন। কোন মন্তব্য করেননি কিংবা মন্তব্যের ব্যাপারে নাগালের বাইরে থেকে গেছেন। তাই ‘প্লেয়িং ইট মাই ওয়ে’-তে ম্যাচ-ফিক্সিংয়ের ব্যাপারে চমক লাগানো কোন তথ্য আশা করা যাবে না। প্রথমত, ইস্যুটাই অত্যন্ত বিতর্কিত এবং দ্বিতীয়ত, শচীন এ সংক্রান্ত গোপন কোন তথ্য ফাঁস করলে আইনগত সমস্যাও দেখা দিতে পারে। তেমনি ২০০৮ সালের ভারত-অস্ট্রেলিয়া সিরিজ চলাকালে হরভজন সত্যিই সাইমন্ডসকে ‘মাঙ্কি’ বলেছিলেন কিনা তাও তার কাছ থেকে সম্ভবত জানা যাবে না। কারণ অস্ট্রেলিয়ায় বিচারকম-লীর কাছে শচীন বলেছিলেন, হরভজন আসলে বলেছিলেন মা কি। শচীন তাঁর বইয়ে সম্ভবত একথাও স্বীকার করবেন না যে একটা ফ্ল্যাটে উইকেটে দুর্বল বোলিং আক্রমণের বিরুদ্ধে তাঁর একশ’তম আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরি করতে গিয়ে অত্যন্ত মন্থর ব্যাটিং করেছিলেন। ওই সেঞ্চুরির জন্য তিনি ১৩৮টি বল খেলেছিলেন। এককালের ঘনিষ্ঠ বন্ধু বিনোদ কাম্বলী শচীন সম্পর্কে প্রকাশ্যে বিরূপ মন্তব্য করলেও শচীন বইতে সম্ভবত তাঁর সম্পর্কে কটু কোন বক্তব্য দেবেন না। ফিয়াট কোম্পানির দেয়া উপহার ‘ফেরারি’ গাড়ি নিয়ে যে বিতর্ক উঠেছিল আত্মজীবনীতে শচীন সে ব্যাপারে সম্ভবত নীরব থাকবেন।
×