ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

পবিত্র আশুরার গুরুত্ব

প্রকাশিত: ০৪:৩৩, ৪ নভেম্বর ২০১৪

পবিত্র আশুরার গুরুত্ব

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম আশুরা বলা হয় মহরম মাসের দশ তারিখকে। বিশ্বজাহান সৃষ্টির সূচনা থেকে শুরু করে বিভিন্ন যুগে বহু গুরুত্বপূর্ণ ও মাহাত্ম্যম-িত ঘটনা ঘটেছে আশুরাতে। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু নিজেকে প্রকাশ করবার জন্য যেদিন সৃষ্টির সূচনা করেন সেদিন ছিল আশুরা। এখানে উল্লেখ্য যে, আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু সর্বপ্রথম নূরে মুহম্মদী সৃষ্টি করে সৃষ্টির সূচনা করেন। মানব জাতির আদি পিতা হযরত আদম ‘আলায়হিস সাল্লামের দেহে যেদিন আল্লাহ্ জাল্লা জানুহু রূহ ফুঁকে দেন অর্থাৎ তাঁর দেহে প্রাণ দান করেন সেদিন ছিল আশুরা। হযরত অদম (আ.) ও মানব জাতির আদি মাতা হযরত হাওয়া ‘আলায়হাস সাল্লাম জান্নাত থেকে যেদিন বহিষ্কৃত হয়ে পৃথিবীতে অবতরণ করেন সেদিনও ছিল আশুরা। জানা যায় হযরত আদম ‘আলায়হিস সাল্লামকে বর্তমান শ্রীলঙ্কার একটি পাহাড়ের শীর্ষে নামানো হয়, আর মা হাওয়া ‘আলায়হিস সাল্লামকে নামানো হয় লোহিত সাগরের তীরে, জেদ্দাতে। হযরত আদম ‘আলায়হিস সাল্লাম প্রায় সাড়ে তিনশত বছর ধরে আল্লাহ্র নিকট ক্ষমা চেয়ে কান্নাকাটি করেন। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু যেদিন শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর উসিলায় আদম (আ.)-এর তওবা কবুল করেন সেদিন ছিল আশুরা। হযরত নূহ ‘আলায়হিস সাল্লামের সময় যে মহাপ্লাবন হয় সেই মহাপ্লাবন হতে রক্ষা পাবার জন্য আল্লাহ্র নির্দেশে তিনি একটি বিরাট জাহাজ বানিয়ে তাতে আরোহণ করেন। প্লাবন শেষে যেদিন তিনি জাহাজ থেকে যুদী পাহাড়ে অবতরণ করেন সেদিনটি ছিল আশুরা। হযরত ইব্রাহিম ‘আলাইহিস সাল্লাম নমরুদের অগ্নিকু- হতে যেদিন উদ্ধার পেয়েছিলেন সেদিন ছিল আশুরা। এমনিভাবে হযরত ইউনূস ‘আলায়হিস সাল্লামের মাছের পেট থেকে উদ্ধার লাভ, হযরত ইউসুফ ‘আলায়হিস সাল্লামের ৪০ বছর পর পিতা হযরত ইয়াকুব ‘আলায়হিস সাল্লামের সঙ্গে মিলিত হওয়া, সোলায়মান ‘আলায়হিস সাল্লামের হারানো রাজত্ব ফিরে পাওয়া, হযরত আইয়ুব ‘আলায়হিস সাল্লামের দীর্ঘকাল রোগভোগের পর আরোগ্য লাভ, হযরত মূসা ‘আলায়হিস সাল্লামের বনী ইসরাঈলসহ লোহিত সাগর পাড়ি দেয়া এবং সদলবলে ফেরাউনের ডুবে মরা প্রভৃতি অসংখ্য ঘটনার নীরব সাক্ষী হচ্ছে আশুরা। এসব ছাড়া আরও জানা যায়, কিয়ামত হবে ভবিষ্যতের কোন এক আশুরাতে। কিয়ামতের সেই ভীষণ দিনের বিবরণ কুরআন মজীদে রয়েছে। ইরশাদ হয়েছে; মহাপ্রলয়, মহাপ্রলয় কি? মহাপ্রলয় কি তা কি তুমি জান? সেদিন মানুষ হবে বিক্ষিপ্ত পতঙ্গের মতো, পর্বতসমূহ হবে ধুনাই করা রঙ্গিন তুলোর মতো। (সূরা কারি’ আ : আয়াত ১-৫)। আশুরার মাহাত্ম্য সম্পর্কে হাদিস শরীফে বিস্তর বর্ণনা রয়েছে। রমাদানের সিয়াম ফরয হবার পূর্বে প্রিয়নবী রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম নিজে এবং তাঁর নির্দেশে সাহাবায়ে কেরাম আশুরাতে সিয়াম পালন করতেন, এমনকি পরবর্তীতেও এই সিয়াম পালিত হয়। ৬৮০ খ্রিস্টাব্দের ১০ মহরম হযরত ইমাম হুসাইন রাদিআল্লাহু তা’আলা আন্হু সত্য ও সুন্দরকে প্রতিষ্ঠা করবার জন্য, হক ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করবার জন্য কারবালা প্রান্তরে আত্মত্যাগে এবং আত্ম্যোৎসর্গের যে অপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন তা পৃথিবীর মানুষকে ন্যায়ের সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়বার প্রেরণা যুগিয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে। ইয়াযীদ ছিল দুর্দান্ত প্রকৃতির লোক। ইসলামের সূচনাকাল থেকে যে মুনাফিক ও ইয়াহুদী চক্র ইসলামের ধ্বংস সাধনে লিপ্ত ছিল সেই চক্রের পেতাত্মারা ভর করে নরাধম ইয়াযীদের উপর।এরই প্রতিবাদ করতে এগিয়ে আসেন সত্যের সৈনিক হযরত ইমাম হুসাইন রাদিআল্লাহু তা’আলা আন্হু। হযরত ইমাম হুসাইন (রা.)-এর পিতা ইসলামের চতুর্থ খলীফা হযরত আলী রাদিআল্লাহু তা’আলা আন্হু খিলাফতের রাজধানী মদীনা থেকে কুফাতে স্থানান্তর করেছিলেন। হযরত মু’আবিয়া (রা.) দামেস্কে খিলাফতের রাজধানী স্থানান্তর করেছিলেন। এই দামেস্কের মসনদেই ইয়াযীদ আসীন হয়। কুফার জনগণ ইয়াযীদকে খলিফা হিসেবে মেনে নিতে পারেনি। তারা হযরত ইমাম হুসাইন (রা.)-কে চিঠির পর চিঠি নিয়ে কুফায় যাবার জন্য দাওয়াত জানাতে থাকে। হযরত ইমাম হুসাইন (রা.) চিঠিগুলোর সত্যতা ও নির্ভরযোগ্যতা যাচাইয়ের জন্য তাঁর চাচাতো ভাই মুসলিম বিন আকিলকে কুফায় পাঠিয়ে দেন। হযরত মুসলিম বিন আকিল কুফায় এসে দেখতে পান যে, সত্যি সত্যি কুফার জনগণ হযরত ইমাম হুসাইন (রা.) কে চায়। কুফার এই অবস্থা দেখে তিনি হযরত ইমাম হুসাইন (রা.)-কে কুফায় আসবার জন্য পত্র পাঠালেন। পত্র পেয়ে হযরত ইমাম হুসাইন (রা.) সপরিবারে কুফার উদ্দেশে রওনা হলেন। ইমাম হুসাইন (রা.) সপরিবারে একটি কাফেলাসহ কুফা সীমান্তে পৌঁছলে ওবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদের বাহিনী তাঁকে কুফায় প্রবেশ করতে দিল না। কুফা নগরীতে প্রবেশে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে ইমাম হুসাইন (রা.) ফোরাত নদীর তীরে অবস্থিত কারবালা প্রান্তরে এসে তাঁবু স্থাপন করলেন। ইয়াযীদ বাহিনী সেই তাঁবুগুলোর চারদিকে বেষ্টনী দিয়ে ঘেরাও করল।এই অবস্থা নিরসনের জন্য ইমাম হুসাইন (রা.) ইয়াযীদ বাহিনীর সেনাপতির কাছে কয়েকটি প্রস্তাব রাখলেন। তিনি প্রস্তাবে বললেন, আমাকে মদীনায় ফিরে যেতে দাও অথবা আমাকে ইয়াদীদের কাছে নিয়ে যাও। কিন্তু কোন প্রস্তাবই দুশমন সেনাপতি গ্রহণ করল না। হযরত ইমাম হুসাইন রাদিআল্লাহু তা’আলা আনহুর শহীদ হবার মধ্য দিয়ে সত্যের পতাকা সমুন্নত হলো। হযরত ইমাম হুসাইন রাদিআল্লাহু তা’আলা আনহু সেদিন কারবালা প্রান্তরে যে বীরত্ব প্রদর্শন করলেন, স্বাধীনতা রক্ষার জন্য নিজেকে কুরবান করবার যে নজির স্থাপন করলেন তা যুগে যুগে মুসলিম মননে বিপ্লবী চেতনার স্ফুরণ ঘটিয়ে আসছে। সত্যের সাধনা, শৌর্য, ও ত্যাগের অপূর্ব মহিমায় সমুজ্জ্বল আশুরা প্রতিবছর আসে। কারবালায় হযরত ইমাম হুসাইন রাদিআল্লাহু তা’আলা আনহুর শাহাদতের মধ্য দিয়ে সত্যের বিজয় নিশান উন্নত হয়েছে, অন্যদিকে ইয়াযীদ ইতিহাসে চিরধিকৃত হয়ে রয়েছে। যুগ শ্রেষ্ঠ সুফী কুত্বুল আলম হযরত মওলানা শাহ সুফী তোয়াজউদ্দীন আহমদ রহমাতুল্লাহি ‘আলায়হি বলেছেন যে, সবর ও শোকরের মহাশিক্ষা আমরা আশুরা থেকে পেয়ে থাকি। এ দিবস আত্ম আবিষ্কার করবার তাকিদ দেয়। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, ‘ফিরে এলো আজ সেই মুর্হরম মাহিনা। ত্যাগ চাই, মর্সিয়া ক্রন্দন চাহি না।’ কবির এই উচ্চারণে আশুরাতে ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর হবার তাকীদ লক্ষ্য করা যায়। আশুরা একটি পবিত্র দিন। শিরক ও বিদ’আত করে আমরা যেন এই পবিত্র দিনটির পবিত্রতা বিনষ্ট না করি সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। সত্য ও সুন্দরকে জানবার এবং সত্য ও সুন্দরের প্রতিষ্ঠায় আত্মনিয়োগের দৃঢ় প্রত্যয় গ্রহণ করবার মধ্যে আশুরার তাৎপর্য নিহিত রয়েছে। লেখক : পীর সাহেব দ্বারিয়াপুর শরীফ, উপদেষ্টা ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (সা.), সাবেক পরিচালক ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ
×