ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

হিযবুতকে সঙ্গে নিয়ে শিবিরের ঢাবি দখলের মিশন!

প্রকাশিত: ০৪:৩০, ২ নভেম্বর ২০১৪

হিযবুতকে সঙ্গে নিয়ে শিবিরের ঢাবি দখলের মিশন!

গাফফার খান চৌধুরী ॥ ছাত্রশিবির এবার প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। প্রতিষ্ঠানটির ওপর পুরোপুরি না হলেও আংশিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী অত্যন্ত গোপন তৎপরতা চালাচ্ছে। ছাত্রশিবিরের এই অপতৎপরতার সঙ্গে গোপনে কাজ করছে আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন হিযবুত তাহরীর। রানা প্লাজা ধসের পর বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যঙ্গ ছবি তৈরি করে নানা আপত্তিকর বক্তব্য লিখে তা ব্যাপকভাবে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়ার আলোচিত ঘটনায় জড়িত শিবির সদস্য ঢাবি ছাত্র হায়দার আলী মিঝিকে সম্মিলিত জিজ্ঞাসাবাদে মিলেছে এমন তথ্য। দীর্ঘদিন ধরেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শেখ হাসিনাকে নিয়ে নানা কুৎসা-ব্যঙ্গাত্মক প্রচার ও আপত্তিকর ছবিসহ প্রপাগান্ডা চালাচ্ছিল জামায়াত-শিবির। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারের রানা প্লাজা ধসের পর বীভৎস-ব্যঙ্গাত্মক প্রচার শুরু করে তারা। প্রচারের সঙ্গে জড়িত থাকা সন্দেহের তালিকায় ছিল জামায়াত-শিবির। ওই সময় বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যঙ্গাত্মক ছবি পোস্টার আকারে ছাপিয়ে সাভারসহ সারাদেশেই প্রচার করা হয়। এ নিয়ে রীতিমতো তোলপাড় চলছিল। ঘটনার তদন্তে নামে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দারা। দীর্ঘ তদন্তে অবশেষে বেরিয়ে আসে ঢাবির ছাত্র-শিক্ষিক কেন্দ্রের (টিএসসি) ফ্রি ওয়াইফাই জোন ব্যবহার করে ব্যাপক প্রপাগান্ডা চালানোর ঘটনাটি। শুরু হয় প্রচারের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতারে সাঁড়াশি অভিযান। এরই ধারাবাহিকতায় গত ২১ অক্টোবর গ্রেফতার হয় হারুন-উর-রশিদ। ২৬ অক্টোবর সুফিয়া কামাল হল থেকে উদ্ধার হয় বিপুলসংখ্যক জিহাদী বই, রাষ্ট্র ও সরকারবিরোধী লেখা সংবলিত লিফলেট। জিহাদী কার্যক্রমে জড়িত থাকার দায়ে অভিযুক্ত করা হয় ২০ ছাত্রীকে। তাদের হল ত্যাগ করতে নোটিস জারি করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এ ঘটনায় ঢাবি ছাত্রশিবির ও তাদের সহযোগী সংগঠন ছাত্রী সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন হিযবুত তাহরীরের কার্যক্রম চালানোর বিষয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসে। এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক আমজাদ আলী জনকণ্ঠকে জানান, নিষিদ্ধ সংগঠনের কার্যক্রমের ওপর তারা নজরদারি অব্যাহত রেখেছেন। ঢাবিতে কোন নিষিদ্ধ সংগঠনের তৎপরতা নেই বলেও দাবি করেন তিনি। গত ২১ অক্টোবর রাত সাড়ে আটটার দিকে পুলিশ আর গোয়েন্দাদের যৌথ অভিযানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকা থেকে গ্রেফতার হয় হায়দার আলী মিঝি ওরফে হারুন-উর-রশিদ ওরফে মামুন (২৫)। তার দেহ তল্লাশি করে উদ্ধার করা হয় পেনড্রাইভ। পেনড্রাইভে থাকা তথ্য খুঁজতে গিয়ে গোয়েন্দাদের চক্ষু চড়কগাছ। উদ্ধার হয় সাভারের রানা প্লাজা ধসের পর বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ব্যঙ্গ করে তৈরি নানা কার্টুন আর রাষ্ট্র ও সরকারবিরোধী লেখা সংবলিত পোস্টার তৈরি করে তা প্রচারের তথ্য। পেনড্রাইভে মেলে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ব্যঙ্গাত্মক ভাষণ আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যঙ্গাত্মক ছবি। সেই পেনড্রাইভ থেকেই ল্যাপটপের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া হয় সব। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ ব্যঙ্গ করে লেখা হয়েছে, ‘এবারের সংগ্রাম ইসলাম ধ্বংস করার সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম, বাংলার মানুষকে হত্যা করার সংগ্রাম। রক্ত যখন খেয়েছি, রক্ত আরও খাব, এ দেশকে ভারতের অঙ্গরাজ্য বানিয়ে ছাড়ব।’ আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি ব্যঙ্গ করে ছাপিয়ে তার সঙ্গে নচিকেতার একটি গানের আদলে প্যারোডি করে লেখা হয়েছে, রানা প্লাজাটা ধসে গেছে দাদা শুনছো, এখন আর কেউ আটকাতে পারবে না, রামপালটা (বিদ্যুত কেন্দ্র) এবার ওদের দিয়ে দিতেই পারি, দাদাদের বলো ডিল ক্যান্সেল করছি না। সুন্দরবন আর রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্রের চুক্তি, তিস্তা, টিপাই আর ট্রানজিট দিয়ে শেখ হাসিনা ক্ষমতা পেয়েছে বলেও লেখা হয়েছে ব্যঙ্গাত্মকভাবে। এক বৃদ্ধাকে শেখ হাসিনা সাজিয়ে তাঁকে লাল শাড়ি পরিয়ে কৈশোর পেরুনো সদা হাস্যোজ্জ্বল যুবতী বলে ব্যঙ্গাত্মকভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়াও শেখ হাসিনার মাথায় হিজাব আর হাতে হুইস্কির গ্লাস ধরিয়ে দিয়ে চিয়ার্সরত ব্যঙ্গাত্মক ছবি বানিয়ে তার নিচে লেখা হয়েছে, হে! পরওয়ারদিগার আওয়ামী লীগই যদি দুনিয়াতে পাঠাবে, তাহলে শয়তান পাঠানোর কি দরকার ছিল? এসব ছবি সাভারের রানা প্লাজা ধসের পর ইন্টারনেটসহ বিভিন্ন মাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয়েছিল। এ ব্যাপারে রাজধানীর শাহবাগ মডেল থানায় তথ্যপ্রযুক্তি আইনে একটি মামলা দায়ের করেন থানার উপ-পরিদর্শক সুব্রত গোলদার। মামলাটি একই থানার উপ-পরিদর্শক আনারুল ইসলাম তদন্ত করছেন। আসামি হারুন বর্তমানে কারাবন্দী। হারুনকে জিজ্ঞাসাবাদ ও প্রাপ্ত সরকারী নথিপত্র সূত্রে জানা গেছে, গ্রেফতারকৃত মামুনের পিতার নাম আব্দুস সাত্তার মিঝি। মা সুফিয়া বেগম গৃহিণনী। স্থায়ী ঠিকানা লক্ষীপুর জেলার রামগঞ্জ থানাধীন মাসুমপুরের মিঝিবাড়ি। জন্ম ১৯৮৯ সালের ১০ আগস্ট। দুই ভাই এক বোনের মধ্যে মামুন সবার বড়। তার ছোট বোন মুক্তা (২০) ইডেন কলেজের ফিন্যান্স এ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের সম্মান শ্রেণীতে পড়ে। সবার ছোট ভাই নাছির। সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র। তার চাচা হারুন মনির আর মামা ফিরোজ সৌদি আরব প্রবাসী। মামুন ২০১১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাণিজ্য অনুষদের অধীন আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিষয়ে বিবিএ পাস করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ১১৩ নম্বর কক্ষের ছাত্র ছিলেন। এরপর তিনি ভারতের দিল্লীর সাউথ এশিয়ান ইউনিভার্সিটি থেকে উন্নয়ন অর্থনীতি বিভাগে এমএ পাস করেন। এরপর দেশে ফেরেন। সূত্র বলছে, বুয়েট, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, জাহাঙ্গীরনগর, সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, শেরেবাংলানগর ও ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবিরের আধিপত্য রয়েছে। এর মধ্যে রাজশাহী ও চট্টগ্রামে তাদের আধিপত্য বেশি। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও ছাত্রশিবির আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করছে। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয়টিতে পড়ুয়া ছাত্রশিবিরের একাধিক নেতাকর্মীকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তাদেরই একজন গ্রেফতারকৃত মামুন। জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে গোয়েন্দা সূত্র বলছে, মামুন কলেজ জীবন থেকেই ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর ছাত্রশিবিরের প্রকাশ্য রাজনীতি করতে সমস্যা হচ্ছিল। এজন্য তিনি চলে যান সংগঠনটির গোপন কার্যক্রমে। তার প্রধান কাজ ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেকটি ছাত্র হলে শিবিরের নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা। কোন্ হলে কত ছাত্র শিবির নেতাকর্মী রয়েছে তার ফিরিস্তি রাখা। তারা সংগঠনের গোপন কার্যক্রম চালাচ্ছে কিনা তার দেখভাল করা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি আবাসিক হলে ছাত্রশিবিরের অন্তত ২৫ থেকে ৩০ জন করে সদস্য রয়েছে; যারা সাধারণ ছাত্রের ছদ্মবেশে আবার ক্ষমতাসীন দলের কর্মী হিসেবে অবস্থান করে। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারদিকে ছদ্মবেশে জামায়াত-শিবিরের প্রচুর লোক রয়েছে। এদের মধ্যে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এসব ব্যবসায়ীকে জামায়াত-শিবির টাকা দিয়ে ব্যবসা ধরিয়ে দিয়েছে। তাদের প্রধান কাজ জামায়াত-শিবিরের হয়ে তথ্য সংগ্রহ করে দেয়া। তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি হল, ক্যান্টিন, হলের সামনে, ফুটপাথে ভাসমান দোকান বসিয়ে অবস্থান করছে। এমনকি বহু ভাসমান লোক রয়েছে জামায়াত-শিবিরের। বিশ্ববিদ্যালয়টির চারদিকে বিভিন্ন বাসাবাড়ি ও মেসে ছাত্রশিবিরের লোকজন অবস্থান করছে। বিশেষ করে কাঁটাবন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মার্কেট, নীলক্ষেত মার্কেট, চাঁদনী চক, কাঁটাবন মসজিদের আশপাশের এলাকা, এলিফ্যান্ট রোড, এর ঢাল, পরীবাগ, চাঁনখারপুল ও তার আশপাশের এলাকা, আজিমপুর, লালবাগ, ফার্মগেটসহ বিভিন্ন এলাকায় জামায়াত-শিবির বছরের পর বছর ধরে ঘাঁটি গেড়ে বসে আছে। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কোন অফিস বা প্রতিষ্ঠান যেখানেই রয়েছে তারই আশপাশে জামায়াত-শিবির শক্ত অবস্থান গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। শাহবাগ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সিরাজুল ইসলাম জনকণ্ঠকে জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবির ও নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন হিযবুত তাহরীরের মতো কোন নিষিদ্ধ সংগঠনের প্রকাশ্য তৎপরতা নেই। তবে কিছুটা গোপন তৎপরতা থাকার তথ্য রয়েছে তাদের কাছে। এজন্য নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। গোপন তৎপরতার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতারে সাঁড়াশি অভিযান অব্যাহত আছে।
×