ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বরিশালে সন্ত্রাসী নান্নু বাহিনী

১৩ গ্রামের মানুষ জিম্মি

প্রকাশিত: ০৪:১১, ২ নভেম্বর ২০১৪

১৩ গ্রামের মানুষ জিম্মি

খোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল ॥ তেরো গ্রামের হিন্দু, মুসলমান ও খ্রীস্টসম্প্রদায়ের লক্ষাধিক নিরীহ জনসাধারণ চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও মাদক ব্যবসায়ী নান্নু বাহিনীর হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে। সন্ত্রাসীদের বিভিন্ন অপকর্মের প্রতিবাদ করায় অতিসম্প্রতি ওই বাহিনীর প্রধান নান্নু মৃধা ও তার সহযোগীরা কুপিয়ে খাদেম সরদার নামের এক মুসল্লিকে খুন ও তার পুত্র আসলাম সরদারকে কুপিয়ে গুলুতর জখম করেছে। এ ঘটনার পর ওইসব গ্রামের নিরীহ বাসিন্দাদের মধ্যে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে। নির্যাতিতরা সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু“ করেছেন। সন্ত্রাসী নান্নু ও তার বাহিনীর সদস্যদের জুলুম, অত্যাচার, শারীরিক ও পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়ে ইতোমধ্যে দেশ ছেড়েছেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের চারটি পরিবারের সদস্যরা। ভুক্তভোগী গ্রামবাসীরা একত্রিত হয়ে ‘গ্রাম পরিচালনা কমিটি’ গঠনের মাধ্যমে সন্ত্রাসী মোকাবেলায় এখন রাত জেগে পাহারা বসিয়েছে। এ নিয়ে ওই এলাকায় চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। ঘটনাটি জেলার গৌরনদী উপজেলার বার্থী ইউনিয়নের। অনুসন্ধান ও সরেজমিনে বার্থী ইউনিয়নের মাদকের স্বর্গরাজ্য বলে খ্যাত রাজাপুর, নন্দনপট্টি, বেজগাতি, উত্তর ধানডোবা, গোরক্ষডোবা, দক্ষিণ ধানডোবা, উত্তর মাদ্রা, বাঙ্গিলা, দক্ষিণ মাদ্রা, ধুরিয়াইল, সাজুরিয়া, চেঙ্গুটিয়া ও রামসিদ্ধি ঘুরে ভুক্তভোগী গ্রামবাসীদের সঙ্গথ আলাপ করে জানা গেছে, সন্ত্রাসী নান্নু বাহিনীর ভয়ঙ্করসব অজানা কাহিনী। সূত্রমতে, নন্দনপট্টি গ্রামের মৃত সফিউদ্দিন মৃধার বড়পুত্র পান্নু মৃধা ১৯৯৬ সালে বার্থী ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন তার সহদর নান্নু মৃধা ও সেন্টু মৃধা। ফলে খুব সহজেই গৌরনদীর শীর্ষ সন্ত্রাসী বার্থীর হাবুল প্যাদার সন্ত্রাসী গ্রুপের সেকেন্ড ইন কমান্ডের দায়িত্ব পান নান্নু মৃধা। বিগত ওয়ান ইলেভেনের সময় পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে হাবুল প্যাদা নিহত হওয়ার পর তার অস্ত্রভা-ার নান্নুর কাছেই অক্ষত থেকে যায়। পরবর্তীতে নান্নু তার নিজ নামে ‘নান্নু বাহিনী’ নামের একটি সন্ত্রাসী বাহিনী তৈরি করেন। ওই বাহিনীর সেকেন্ড ইন কমান্ডের দায়িত্ব পালন করেন নান্নুর সহদর সেন্টু মৃধা ও কটকস্থল গ্রামের হারুন সিকদারের পুত্র আল-মাদানী সিকদার। এলাকায় একক আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে ২০১১ সালে নান্নু মৃধা নিজের সন্ত্রাসী বাহিনীর প্রভাবে ইউপি সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর আর থেমে থাকতে হয়নি তাকে ও তার বাহিনীর সদস্যদের। বরিশাল জেলার উত্তর জনপদে মাদক সরবরাহের একক আধিপত্য বিস্তার করেন নান্নু বাহিনী। প্রতিনিয়ত সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে বিভিন্ন কৌশলে মাদকের বড় বড় চালান আসতে থাকে বাহিনীর প্রধান নান্নুর কাছে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা একাধিকবার বিপুল পরিমাণ মাদকসহ নান্নু ও তার দলের সেকেন্ড ইন কমান্ড সেন্টু মৃধা এবং আল-মাদানী সিকদারকে গ্রেফতার করেন। কয়েকদিন পর আইনের ফাঁকফোকর পেরিয়ে তারা জামিনে বেরিয়ে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। নিজ গ্রামসহ পার্শ¦বর্তী ১২টি গ্রামে মাদকের নেটওয়ার্ক ছড়িয়ে দিয়ে একক আধিপত্যের জন্য সন্ত্রাসী ওই বাহিনীর প্রধান ও তার সহযোগীরা পুরো ১৩টি গ্রামকে জিম্মি করে রাখেন। সন্ত্রাসী নান্নু ও তার বাহিনীর সদস্যরা গ্রামবাসীকে জিম্মি করে শুরূ“ করেন জমিদখল, জুলুমবাজি, অত্যাচার, শারীরিক ও পাশবিক নির্যাতন। এজন্য তারা গোরক্ষডোবা গ্রামের জনৈক সিদ্দিক সন্যামাতের নির্মাণাধীন পরিত্যক্ত বিল্ডিং দখল করে সেটিকে টর্চার সেল হিসেবে ব্যবহার করেন। ওই সেল থেকেই বিভিন্নস্থানে মাদক সরবরাহ ও নারীদের ইজ্জত হরণ করা হতো। গ্রামবাসী সন্ত্রাসীদের অপকর্মের প্রতিবাদ করলে ওই সেলে বসেই তাদের শারীরিক নির্যাতন করা হতো। স্থানীয় একাধিক সূত্রে জানা গেছে, সন্ত্রাসী নান্নু ও তার বাহিনীর বেপরোয়া সন্ত্রাসী কর্মকা-ের ভয়ে কখনও কেহ মুখ খুলতে সাহস পায়নি। সূত্রে আরো জানা গেছে, নান্নু ও তার আরেক সহযোগী নিত্যানন্দ ম-লসহ অন্য গোরক্ষডোবা এলাকার প্রায় চার শ’ একর জমিতে জোরপূর্বক বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ শুরু“ করেন। এতে জমির প্রকৃত মালিকরা বাধা প্রদান করায় সন্ত্রাসী নান্নু ও তার সহযোগীরা বিভিন্ন সময় খ্রীস্টসম্প্রদায়ের সাইমুন হালদার, জ্যাকব হালদার, বাকপ্রতিবন্ধী রিপন হালদার, হিন্দু সম্প্রদায়ের গৌরাঙ্গ বালা, কালাচাঁদ বালা, মুসলিম সম্প্রদায়ের হারুন হাওলাদার, রিজিয়া বেগম, ছালাম সেরনিয়াবাত, আফজাল চৌকিদার, মাওলা চৌকিদার, মোকলেচ মৃধাকে মারধর করে গুরুতর আহত করে। এছাড়া বিভিন্ন সময় সন্ত্রাসী ও মাদক ব্যবসার প্রতিবাদ করায় আরও প্রায় অর্ধশত ব্যক্তিকে টর্চার সেলে নিয়ে মারধর করা হয়। ওই সন্ত্রাসীদের জুলুম, অত্যাচার, বাড়ির গৃহবধূ ও যুবতী মেয়েদের পাশবিক নির্যাতন কিংবা হুমকির মুখে ইতোমধ্যে সপরিবারে দেশত্যাগ করেছেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের গৌর বালা, কৃষ্ণ দাস, চিত্ত দাস ও নারায়ণ দাস।
×