ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

আবদুল মান্নান

নিজামীর রায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে একটি মাইলফলক

প্রকাশিত: ০৩:৫৮, ২ নভেম্বর ২০১৪

নিজামীর রায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে একটি মাইলফলক

দীর্ঘ প্রতীক্ষা আর অনেক জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে গত বুধবার একাত্তরে জামায়াতে ইসলামের ভয়ঙ্কর ঘাতক বাহিনী আলবদর বাহিনীর প্রধান মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির আদেশ দিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। একাত্তর সালে নিজামী ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি ছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরবর্তীকালে জিয়া রাষ্ট্রপতির পদটি দখল করেন। ১৯৭৭ সালে সাংবিধানিকভাবে নিষিদ্ধ ঘোষিত ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোকে তিনি রাজনীতি করার অনুমতি দিলে ছাত্রসংঘ ১৯৭৭ সালেই ইসলামী ছাত্রশিবির নামে পুনর্জন্ম লাভ করে। ছাত্রশিবিরের সদস্যরাই নিজামীর অধীনে একাত্তরে আলবদর নাম ধারণ করেছিল এবং তারা হিটলারের গুপ্ত ঘাতক গেস্টাপোর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক দখলকৃত বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী হত্যাকা- আর মুক্তিযোদ্ধা হত্যার সঙ্গে জড়িত হয়েছিল। আলবদর সদস্যদের পাকিস্তানী সেনাবাহিনী প্রশিক্ষণ দিত। সেই সব হত্যাকা-ের সঙ্গে নিজামী পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন বলে ট্রাইব্যুনালে তা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। ষোলোটি অভিযোগের মধ্যে ট্রাইব্যুনাল আটটি অভিযোগের প্রমাণ গ্রহণ করেছে এবং চারটিতে মৃত্যুদ- ও চারটিতে যাবজ্জীবন কারাদ- দিয়েছে। বাকি আটটি অভিযোগ হতে নিজামীকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। নিজামীর ছাত্রসংঘ একাত্তরে মানুষ হত্যা করত আর ছাত্রসংঘের বর্তমান সংস্করণ ছাত্রশিবির হত্যা ছাড়াও মানুষের পায়ের রগ কেটে তাকে চিরতরে পঙ্গু করে দেয়। বাংলাদেশ পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর দখলমুক্ত হওয়ার পর অন্য আরও যুদ্ধাপরাধীর সঙ্গে নিজামীও লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যান। তাঁদের মূল মন্ত্রগুরু গোলাম আযম নবেম্বর মাসে বুঝতে পারেন তাঁর সাধের পাকিস্তানের আয়ু ফুরিয়ে আসছে। তিনি পাকিস্তান পাড়ি জমান। সেখান হতে তিনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টোর সহায়তায় বাংলাদেশবিরোধী তৎপরতা চালাতে মধ্যপ্রাচ্য ও অন্যান্য আরব দেশে প্রচার চালানো শুরু করেন। সৌদি বাদশাহ ফয়সালকে সাতবার অনুরোধ করেন যেন তিনি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেন। পরে লন্ডনে গিয়ে ‘পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটি’ নামের একটি সংগঠন খুলে মানুষের কাছ হতে দু’হাতে চাঁদা তোলা শুরু করেন। তিনি অনেককে বুঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন বাংলাদেশে সকল মসজিদ মাদ্রাসা ভেঙ্গে সেখানে মন্দির গড়ে তোলা হয়েছে। পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে সকল পবিত্র কোরান শরীফ। এগুলো নির্মাণ ও কোরান শরীফ ক্রয়ের জন্য প্রয়োজন অনেক অর্থ। অনেকেই তাঁর কথায় বিশ্বাস করে তাঁকে কোটি কোটি টাকার চাঁদা দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর নিষিদ্ধ ঘোষিত জামায়াতকে জিয়া পুনরায় রাজনীতি করার সুযোগ দিলে আস্তে আস্তে নিজামী গং আবার জনসম্মুখে আসা শুরু করেন। গোলাম আযম দেশে ফিরে জামায়াতের আমির হন। প্রথমে আত্মপ্রকাশ করে ইসলামী ছাত্রশিবির। নিজামী প্রথমে জামায়াতের সাধারণ সম্পাদক ও পরে আমির হন। ১৯৯১ সালের সাধারণ নির্বাচনে জামায়াত আর বিএনপির মধ্যে সিট ভাগাভাগির একটি অলিখিত চুক্তি হয় এবং সেই নির্বাচনে বেগম জিয়ার বিএনপি বিজয় লাভ করে সরকার গঠন করে। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে বেগম জিয়া নিজামীকে তাঁর মন্ত্রিসভায় ঠাঁই করে দেন। নিজামীর রায়ে বিচারপতিরা ঠিকই মন্তব্য করেছেন এটি ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নিহত ত্রিশ লাখ শহীদ ও দু’লাখ সম্ভ্রম হারানো মা বোনের প্রতি চপেটাঘাত। যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত নিজামীর বিচারের শুনানি ছিল দীর্ঘতম। শুরু হয়েছিল ২০১২ সালের ২৮ মে আর শেষ হয় ২০১৩ সালের ১৩ নবেম্বর। গত ২৪ জুন রায় ঘোষণা করার কথা ছিল। শেষ মুহূর্তে কারা কর্তৃপক্ষ জানালেন নিজামী ‘অসুস্থ’। আবার পিছিয়ে তা দেয়া হলো বুধবার। নিজামীর পক্ষ হতে এই বিচারকে বানচাল করার জন্য অঢেল অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চলমান এই বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য কয়েক কোটি টাকা দিয়ে নিযুক্ত করা হয়েছে ইহুদি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ আইনজীবী টোবি ক্যাডমেন ও তাঁর ফার্মকে। ক্যাডমেন তাঁর মক্কেলের খায়েশ পূরণে যুক্তরাষ্ট্র ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে একাধিকবার সফর করেছেন। গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে সাক্ষাত করে দেনদরবার করেছেন। অর্থের বিনিময়ে সংবাদপত্রে সাক্ষাতকার দিয়েছেন। অভিযোগ আছে, এই অর্থের একটি বিরাট অংশ দেশে ও বিদেশের মিডিয়াতেও গেছে যাতে তারা নিজামীর পক্ষে ও ট্রাইব্যুনালের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। গত ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পূর্বে জামায়াত যেভাবে উন্মত্ত ও হিংস্র হয়ে উঠেছিল তার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে হটিয়ে বিএনপিকে ক্ষমতায় আনা। তা সম্ভব হলে নিশ্চয় এই বিচার বন্ধ হয়ে যেত। শেখ হাসিনার দৃঢ় ও সাহসী অবস্থানের কারণে সেটি করতে তারা ব্যর্থ হয়েছে। জামায়াত-শিবির হুমকি দিয়েছিল একদিনের জন্যও যদি নিজামীকে দ- দেয়া হয় তাহলে তার পরিণতি হবে ভয়াবহ। নিজামীর রায়ের পরপরই তারা তিন দিনের হরতাল ডেকেছে। এতে অন্য কারও তেমন অসুবিধা না হলেও অসুবিধা হয় শিক্ষার্থীদের। শিক্ষা তাদের পছন্দ নয়। আর এই অর্থহীন হরতাল ডেকে কী লাভ? তারা কী মনে করে এতে নিজামীর দ- মওকুফ হয়ে যাবে? এমন ঘটনা তো বিশ্বের কোথাও কখনও ঘটেছে বলে শুনিনি। নিজামীর রায়ের সময় ট্রাইব্যুনাল মন্তব্য করেছে ইসলামী ছাত্রসংঘ ও আলবদর শুধু ক্রিমিনাল সংগঠনই নয় তারা মৌলবাদী সংগঠনও বটে। এর আগে ট্রাইব্যুনাল অন্য রায়ে জামায়াত সম্পর্কে একই মন্তব্য করেছে। ব্রিটেনের জেনস ডিফেন্স উইকলি শিবিরকে বিশ্বের তৃতীয় ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। এখন সময় হয়েছে জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার। এখানে দোদুল্যমানতার কোন অবকাশ নেই। নিজামীর রায়ে তার সাধের পাকিস্তানের জামায়াত তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। তারা বাংলাদেশকে হুমকি দিয়ে ক্ষান্ত হয়নি, পাকিস্তান সরকারকে অনুরোধ করেছে যেন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে। পাকিস্তান কী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে তা পরিষ্কার নয়। বাংলাদেশ তো আর সত্তরের বাংলাদেশ নয় । শুধু তারা বাংলাদেশে আইএসআইর কর্মকা- বাড়িয়ে দিতে পারে। ৯০ বছর কারাদ-প্রাপ্ত ঘাতকদের মন্ত্রগুরু গোলাম আযমের প্রিজন সেলে মৃত্যু হলে পাকিস্তান জামায়াত একাধিক শহরে তার জন্য গায়েবানা জানাজা পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এই বিষয়ে তার অতীত অবস্থান হতে সরে এসে বলেছে, ‘আমরা বাংলাদেশের দুঃখজনক অতীতের অনুভূতি বুঝি’। ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাঁর মৃত্যুদ- রহিত করার আহ্বান জানিয়েছে আর এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল পুরো রায়কে পুনর্বিবেচনার দাবি জানিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল কথায় কথায় বাংলাদেশের মাথার ওপর ছড়ি ঘোরাতে পছন্দ করে। কিন্তু ন্যাটোর সদস্য হিসেবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো আফগানিস্তান আর ইরাকে যখন বিরামহীনভাবে বোমাবর্ষণ করে নিরীহ মানুষ হত্যা করে তখন তাদের মানবাধিকারের বিষয়টা মনে থাকে না। যুক্তরাষ্ট্র নিত্যদিন আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের সীমান্ত অঞ্চলে ড্রোন হামলা করে মানুুষ হত্যা করে তখন কিন্তু বিশ্বের কোন মানবাধিকার সংস্থা তেমন একটা উচ্চবাচ্য করে না। গাজায় ইসরাইলী হামলায় শত শত নিরীহ মানুষ মারা গেলে তখন কোথায় ছিল এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বা ইউরোপীয় ইউনিয়ন? বার্মার আরাকান প্রদেশে দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে যে গণহত্যা চলছে তাদের বিরুদ্ধে বিশ্বের এই সব মোড়ল কখন কী ব্যবস্থা নিয়েছে? আসলে এদের কাছে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল বা দেশের জন্য আলাদা আলাদা মানবাধিকারের সংজ্ঞা আছে। এ যাবত বিশ্বে যত গণবিধ্বংসী মারণাস্ত্র ব্যবহার হয়েছে তার সব মালিক ছিল যুক্তরাষ্ট্র। হিরোশিমা নাগাসাকি হতে শুরু করে ভিয়েতনাম কোনটাকেই বাদ দেয়া যাবে না। হিরোশিমা নাগাসাকিতে কয়েক দিনের ব্যবধানে কোন কারণ ছাড়া দুটি পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণ হলো কিন্তু ইউরোপে হলো না। এটির কী ব্যাখ্যা হতে পারে? রবিবার জামায়াতের আর এক ঘাতক মীর কাশেম আলীর রায় হতে পারে। এই মীর কাশেম আলী একাত্তরে চট্টগ্রামের ডালিম হোটেলে যে টর্চার কেন্দ্র খুলেছিল সেখানে আমার একাধিক বন্ধু ও পরিচিতজনকে আলবদররা ধরে নিয়ে গিয়েছিল। তাদের অনেকেই আর ফিরে আসেনি। মীর কাশেম আলী একাত্তরের চট্টগ্রামে একজন ভয়ঙ্কর জল্লাদ হিসেবে পরিচিত ছিল। নন্দন কাননের নজির আহমদ চৌধুরী রোডের সেই ডালিম হোটেল এখনও আছে। তার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় এখনও আমার অনেক বন্ধুর চিৎকার শুনতে পাই। সেই মীর কাশেম আলী বাংলাদেশে শুধু বহাল তবিয়তে ছিলেন তাই নয়, তিনি ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যানও হয়েছিলেন। জিয়ার বদান্যতায় ছাত্রশিবিরের পুনর্জন্ম হলে তিনি তার প্রথম সভাপতি হন। ইসলামী ব্যাংকের নাম মানিলন্ডারিং আর জঙ্গীদের অর্থায়নের সঙ্গে জড়িত বহুদিন ধরে। সম্প্রতি ভারতে জেএমবির যে জঙ্গীরা ধরা পড়েছে তাদের কাছে এই ব্যাংকের মাধ্যমে আইএসআই হতে অর্থ গেছে বলে এখন অভিযোগ উঠেছে। এই ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে এখনও দু’একজন যুদ্ধাপরাধী আছেন বলে অভিযোগ আছে। সরকারের উচিত এই ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের প্রত্যেক সদস্যের অতীত ইতিহাস খুঁজে বের করা। রায়ে মীর কাশেম আলীর কী সাজা হয় জানি না। তবে দেশের মানুষ আশা করে তিনি তাঁর প্রাপ্য সাজাই পাবেন। নিজামীর সাজা হয়েছে। মীর কাশেম আলীর রায় হবে। এই কয়েকজনের মামলা নিয়ে নানা কৌশলে জামায়াত দীর্ঘসূত্রতার আশ্রয় নিয়েছে। আশা করা যায় তাদের আর সেই সুযোগ দেয়া হবে না। রায় দ্রুততম সময়ে কার্যকর করে এই বিচার নিয়ে মানুষের মনে যা কিছু সংশয় আছে তা দূর করার দায়িত্ব সরকারের। তবে শেখ হাসিনার সরকার যে একটি ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করছে তার কৃতিত্ব তো তাঁকে দিতেই হবে। ৩১ অক্টোবর,২০১৪ লেখক : গবেষক ও বিশ্লেষক।
×