ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

এক পাকি দণ্ডিত লক্ষ পাকি বর্তমান

প্রকাশিত: ০৩:৫৩, ২ নভেম্বর ২০১৪

এক পাকি দণ্ডিত লক্ষ পাকি বর্তমান

আল বদর ও বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনার উদ্দেশ্য, বার বার ইচ্ছাকৃতভাবে এসব বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। এসব প্রশ্ন যে বিভ্রান্তি ছড়ানোর জন্য সেটি তুলে ধরাই উদ্দেশ্য। এবং অতীত ইতিহাস পড়লে এটিও বোঝা যাবে মানবতা বিরোধীদের ক্ষমা করার জন্য কারা চাপ দিচ্ছিলেন। আগে উল্লেখ করেছি মুতিউর রহমান নিজামীকে তার শাগরেদ আল বদর বাহিনীর ডেপুটি মুজাহিদ ‘অলি’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। তাঁর শ্মশ্রুম-িত মুখাবয়ব দেখে অনেকের মনে সে ধারণা হতে পারে। তাছাড়া জামায়াতীরা কথাবার্তায় খুবই ভদ্র। মনে পড়ে, বহু বছর আগে, আমি নিজামীর বিরুদ্ধে একই অভিযোগ করে লিখেছিলাম। জামায়াত তখন একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে জানিয়েছিল, আমি যে সব অভিযোগ করেছি তা ভিত্তিহীন। নিজামী ‘মুনতাসীর মামুনের কোন শিক্ষকের হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিলেন না।’ শুধু তাই নয়, যে যুক্তি তারা উত্থাপন করে তা হলো, মতিউর রহমান নিজামী যদি আল বদর নেতা হতেন তা হলে বঙ্গবন্ধু সরকার তাকে ধরল না কেন? সমস্যা হচ্ছে, ধরা হবে কী হবে? নিজামী ও তার অনুচররা ১৪-১৫ তারিখ থেকেই ঢাকা ছাড়তে শুরু করেন এবং নিজামী পালিয়ে প্রথমে কাঠমু-ু যান তারপর পাকিস্তান। এ কথা লিখেছেন, পাকিস্তানের মনসুর খালেদ, যিনি আল বদরদের ওপর একটি বইও লিখেছেন। নিজামী যদি আল বদর নাই হবেন তা হলে তার নাম কেন হয়েছিল ‘মইত্যা রাজাকার?’। শাহরিয়ার কবির বেশ ক’বছর আগে এ বিষয়ে যখন একটি ডকুমেন্টারি তৈরি করেন তখন বেশ ক’জন ভক্তভোগী মইত্যা রাজাকারের অত্যাচারের কাহিনী বর্ণনা করেন ক্যামেরার সামনে। গোলাম আযমের সঙ্গে নিজামী দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। গোলাম আযম তাকে পছন্দ করতেন দেখেই জামায়াতের আমির করা হয় ও তার জানাজা পড়ানোর জন্য ইচ্ছা প্রকাশ করা হয়। একবার যে আল বদর সে সব সময় আল বদর, একথা আমরা ভুলে যাই। ॥ তিন ॥ যুদ্ধাপরাধ বিচার প্রক্রিয়া, রায়, বিচারক সম্পর্কে নানাবিধ বক্তব্য এসেছে গত একমাস। বিশেষ করে উচ্চ আদালতে সাঈদীর রায়ের পর। সরকারের সঙ্গে আঁতাত হয়েছে এমন প্রচারও করা হয়েছে নিজামীর রায় তৈরি হওয়ার পর না দেয়ায়। বিচারকরাও পাবলিকের নানা মন্তব্যে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। প্রসিকিউশনের সমালোচনায় তাঁরাও ক্ষুব্ধ হয়েছেন। কিন্তু তারা মুদ্রার এক পিঠ দেখে ক্ষুব্ধ হচ্ছেন। প্রসিকিউশন এখনও ব্যক্তি খুনের বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করে। আসামি পক্ষের উকিলরাও। বিচারকরাও। বিচার হচ্ছে গণহত্যার। গণত্যার সাক্ষী হবে কী ভাবে? সে কারণেই কিন্তু এই আইনে প্রচলিত সাক্ষ্য আইন ধর্তব্যের মধ্যে আসবে না। গোলাম আযমের বিচারের সময় আমার মনে আছে, ট্রাইব্যুনালের সামনে এ্যাটর্নি জেনারেল বলেছিলেন, এই মামলায় এত সাক্ষী সাবুদের কোন প্রয়োজন নেই। টিক্কা খানের সঙ্গে গোলাম আযমের বৈঠকের ছবিই গণহত্যা প্রমাণের জন্য যথেষ্ট। আমাদের ‘মাইন্ডসেট’ এত প্রবল যে তা থেকে বের হওয়া মুশকিল। আগেই উল্লেখ করেছি মানবতাবিরোধী অপরাধে ফৌজদারী আইন ধর্তব্যের মধ্যে নয়। কিন্তু বিষয়টি কোন পক্ষকে বোঝানো যাচ্ছে না। ফৌজদারী আইনের মোহ থেকে কোন পক্ষই বেরুতে পারছে না। চার বছর হয়ে গেল। এত লেখালেখি, সেমিনার, বিবৃতি। আলাপ-আলোচনা কোন পক্ষই ধর্তব্যের মধ্যে আনছেন না। এসব কথা তুললেই বলা হয় সমালোচনা করা হচ্ছে যা ঠিক নয়। আলোচনা-সমালোচনার পার্থক্য কে কাকে বোঝাবে? অন্যদিকে আদালতের পর্যবেক্ষণসমূহ ইতিহাসের সত্য যদিও জামায়াতের ভাষ্যানুযায়ী এসব বক্তব্যের কারণ রাজনৈতিক। আলবদর সমাজসেবী সংগঠন না সন্ত্রাসী সংগঠন? আদালতের মতে শুধু সন্ত্রাসী নয়, এটি একটি সাম্প্রদায়িক সংগঠনও এবং রাজনৈতিক দল যেন এ ধরনের সংগঠন নির্মাণ না করে। রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার যে ১৯৭১-এ বিভিন্ন সন্ত্রাসের কারণ তাও বিচারকরা উল্লেখ করেছেন। আমাদের এই অভিজ্ঞতা আছে। যে কারণে, বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের সংবিধানে রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার শুধু নিষিদ্ধ নয়, ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলোকেও নিষিদ্ধ করেছিলেন। আলবদর বন্ধু জিয়াউর রহমান এসে এসব ধারা বাতিল করেন। এ বিষয়টি সব সময় অনুল্লেখ্যও থেকে যায়। বিচারকরা বলেছেন, মতিউর রহমান নিজামীকে মন্ত্রী করার ফলে শহীদদের চপেটাঘাত করা হয়েছে। আসলে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যা ছিল প্রথম চপেটাঘাত, তারপর রাজাকার শাহ আজিজকে প্রধানমন্ত্রী করা ছিল দ্বিতীয় চপেটাঘাত। সুতরাং, জেনারেলদের চপেটাঘাত খেয়েছি [জিয়া-এরশাদ]। ১৫ বছর। খালেদা জিয়া আবদুর রহমান বিশ্বাসকে প্রেসিডেন্ট করে প্রথম চপেটাঘাত করেছিলেন। স্বামী-স্ত্রী দু’জনে মিলে মুক্তিযোদ্ধাদের গালে চপেটাঘাত করছেন, শহীদজায়াদের কাটাঘায়ে নুন-মরিচ ডলে দিচ্ছেন ৩০ লাখ শহীদ হয়েছে কিনা এ প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে, বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম আশ্রয়চ্যুত করেছিলেন জেনারেল জিয়া। স্বাধীনতার পর জামায়াতের উত্থান প্রশ্নে জিয়া ও খালেদা জিয়া এবং এরশাদের নাম অবশ্যই আনা উচিত। কিন্তু, লক্ষণীয় ১৯৭৫ সালের পরের বয়ানে এসব ব্যাপার উল্লিখিত হয় না। বিএনপি যে মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাস করে না তার প্রমাণ মানবতাবিরোধীদের সমর্থন। তাদেরও মানবতাবিরোধী অপরাধে সহযোগিতা করার দায়ে বিচার করা যায় কিনা, সে বিষয়টি নিয়ে এখন ভাবা দরকার। আর যাঁরা বলেন বিএনপিতে মুক্তিযোদ্ধা আছে তারা বিএনপির এ্যাপোলজিস্ট। ঐসব মুক্তিযোদ্ধার নামের আগে মুক্তিযোদ্ধা শব্দটি উর্ধ কমার মধ্যে রাখা শ্রেয়। লক্ষ্য করবেন, মিডিয়ার, প্রশাসনে বা এসটাবলিশমেন্টে বিএনপির প্রতি একটি সুপ্ত অনুরাগ বিরাজমান, এই অনুরাগ কখনও বিরাগ হয় না। কিন্তু, আওয়ামী লীগের প্রতি অনুরাগ, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না থাকলে বিরাগে পরিণত হয়।
×