ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গোপসাগরের মৎস্য গ্রাউন্ডে ঝাঁকে ঝাঁকে ধরা পড়ছে লইট্যা

প্রকাশিত: ০৫:৫৮, ১ নভেম্বর ২০১৪

বঙ্গোপসাগরের মৎস্য গ্রাউন্ডে ঝাঁকে ঝাঁকে ধরা পড়ছে লইট্যা

মহসিন চৌধুরী, চট্টগ্রাম অফিস ॥ লইট্যা প্রজনন মৌসুম কেটে যাওয়ার পরই বঙ্গোপসাগরের প্রায় সব মৎস্য গ্রাউন্ড থেকে উধাও হয়ে গেছে। তবে সাগরে এখন ঝাঁকে ঝাঁকে ধরা পড়ছে লইট্যা মাছ। গত তিনদিন ধরে ফিরিঙ্গীবাজার ফিশারিঘাট এলাকায় দেশী প্রযুক্তির ইঞ্জিন বোটগুলো টনে টনে এ ধরনের মাছ নিয়ে ফিরছে। এতে বাজারে অস্বাভাবিক সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় আড়তে লইট্যা মাছের দাম নেমে এসেছে কেজিপ্রতি ৩০-৪০ টাকায়। সাগরে এখন আর অন্য কোন ধরনের মাছের আধিক্য নেই। কিন্তু লইট্যা মাছের ঝাঁক ধরা পড়ায় অনেকে এটিকে দুর্যোগের পূর্বাভাসও মনে করছেন। জেলেরা জানিয়েছেন, ঘূর্ণিঝড় হুদহুদ কেটে যাবার পর বাংলাদেশের উপকূল এলাকায় এ জাতের মাছ ধরা পড়ছে। সাধারণত এ ধরনের মাছের ঝাঁক যে কোন দুর্যোগের আগে উপকূলের দিকে ছুটে আসে। এ নিয়ে জেলেরা কিছুটা শঙ্কিত। ফিরিঙ্গীবাজার ফিশারিঘাটে ফিরে আসা জেলেরা জানিয়েছেন, গত ৩-৪ দিন ধরে বঙ্গোপসাগরের নিকটবর্তী ফিশিং গ্রাউন্ডগুলোতে ইলিশ, রূপচাঁদা, পোয়া, ছুরি, আইলাসহ বিভিন্ন ধরনের সামুদ্রিক মাছ প্রায় উধাও। গত ১ সেপ্টেম্বর থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রজননের জন্য সব ধরনের ইলিশ আহরণ নিষিদ্ধ ছিল। এ সময় সাধারণত দূরপাল্লা থেকে ইলিশের ঝাঁক নদী মোহনায় মিঠা পানি অথবা অপেক্ষাকৃত কম লবণাক্ত পানিতে ডিম ছাড়তে ছুটে আসে। প্রজননের সুবিধার জন্য ইলিশ আহরণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু এ প্রজনন মৌসুম শেষ হয়ে পনের দিন কেটে গেছে। সাগরে চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপকূল থেকে শত শত ইঞ্জিন বোট ছুটে যায় ইলিশের আশায়। কিন্তু সাউথ প্যাসেজ, সোয়াত অব নো গ্রাউন্ড, এলিফ্যান্ট পয়েন্ট, সেন্টমার্টিনসহ বঙ্গোপসাগরের প্রায় সব ফিশিং গ্রাউন্ডে ইলিশের ঝাঁক নেই। নদী মোহনা থেকে অনেক আগেই মাছের ঝাঁক সরে গেছে। জেলেরা জানিয়েছে, প্রজনন মৌসুম শেষ হওয়ার পরও ইলিশের উপস্থিতি থাকে ব্যাপক। কিন্তু এবার ব্যতিক্রম। তাই প্রজননের সময় ইলিশের ঝাঁক কেমন এসেছিল এটিও স্পষ্ট নয়। নিবিড় প্রজননের জন্য এ বছর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন সংস্থা ব্যাপক ধরপাকড় ও শাস্তি দিয়ে জেলেদের সাগরযাত্রা বন্ধ রেখেছিল। কিন্তু আসলেই ইলিশের ঝাঁক ব্যাপকহারে এসেছে কিনা এ নিয়ে কোন পরিসংখ্যান বা সঠিক চিত্র নেই। প্রজনন মৌসুমের পর সাগরের আচরণে সামনের ইলিশ মৌসুম নিয়ে শঙ্কিত। বৃহস্পতিবার ভোরে চট্টগ্রামের মাছের বৃহৎ আড়ত ফিরিঙ্গীবাজার ফিশারিঘাটে সরেজমিনে দেখা যায়, টনে টনে আসছে লইট্যা মাছ। সাগর থেকে অন্য কোন প্রকার মাছের তেমন আধিক্য নেই। তবে কিছুটা ব্যতিক্রম ছিল ছোট আকৃতির লাক্কা মাছের চালানও। ঘাটে এসেছে ছোট ছোট লাক্কা মাছের চালান। আড়তদাররা জানিয়েছেন, গত তিনদিন ধরে পুরো বাজার সয়লাব লইট্যা মাছে। সপ্তাহ দশ দিন আগেও আড়তে প্রতিকেজি লইট্যা মাছের দাম ৮০ থেকে ১শ’ টাকায় বিক্রি হয়েছিল। বৃহস্পতিবার দাম পড়তে পড়তে ৩০ টাকায় ঠেকেছে। অথচ এ সময় সবচেয়ে বেশি ধরা পড়ার কথা ইলিশের ঝাঁক। কিন্তু জেলেরা হতাশ। পর্যাপ্ত কোন ইলিশ আনতে পারছে না। তাই ভরা মৌসুমেও ইলিশ নেই বাজারে। ছোটখাট চালান আসছে ঘাটে। ফিশারিঘাটের বোট মালিক এবং আড়তদাররা জানিয়েছেন, এখানে প্রতিদিন দেড়শটি আড়তে অন্তত ৪০ থেকে ৫০ টন লইট্যা আসছে। লইট্যা মাছের প্রভাবে অন্যান্য মাছের দামেও প্রভাব পড়েছে। কম দামে মাছ বিক্রি হওয়ায় মিঠা পানির মাছের চাহিদা হ্রাস পেয়েছে। এ ফিশারিঘাটে সাতক্ষীরা থেকে আসা বিপুল পরিমাণ মিঠা পানির মাছ অবিক্রিত থাকায় কোল্ড স্টোরেজে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। প্রতিটি আড়তে বিপুল লইট্যা মাছ বিক্রির পর তা নগরীর সর্বত্র বিক্রি হচ্ছে। নিয়মিত বাজার ছাড়িয়ে ঠেলাগাড়িতেও এ মাছ বিক্রি হচ্ছে নগরীর পাড়া-মহল্লায়। মাছের দাম কমে যাওয়ায় গরুর মাংস এবং মুরগির বাজারেও প্রভাব পড়েছে। কোরবান পরবর্তী সময়ে গরুর মাংসের বাজার আর নড়েচড়ে উঠেনি। সবচেয়ে বেশি লোকসান গুনছে পোল্ট্রি মালিকরা। প্রতিকেজি ফার্মের মুরগি বিক্রি হচ্ছে ১১০ থেকে ১২০ টাকায়। চট্টগ্রামের জেলেরা জানিয়েছেন, সাগরে হঠাৎ লইট্যা মাছ ধরা পড়ার প্রবণতাকে তারা দুর্যোগের পূর্বাভাস বলে মনে করছেন। সাধারণত, এ মাছটি অনেকটা স্পর্শকাতর। তাই দুর্যোগের আগেই সাধারণত এ মাছটি দলছুট হয়ে উপকূলের দিকে ছুটে আসে। একই অবস্থা ইলিশ মাছের ক্ষেত্রেও হয়ে থাকে। তবে দূরপাল্লার যাত্রায় ইলিশের গতি বেশি। দুর্যোগের কারণে ইলিশের দল উপকূলমুখী না হয়ে অন্যদিকেও হতে পারে। এতে হয়ত প্রজননের ভরা মৌসুমে নদী মোহনামুখী হতে বাঁধাপ্রাপ্ত হয়েছে। বিশেষ করে প্রজননের সময়ে বঙ্গোপসাগরে অতি মারাত্মক ঘূর্ণিঝড় হুদহুদ সৃষ্টি হওয়ায় প্রভাব পড়তে পারে। জেলে এবং চট্টগ্রামের ফিশিং ব্যবসায়ীরা আসন্ন মৌসুমে সাগরের বিভিন্ন গ্রাউন্ডে রকমারি প্রজাতির মৎস্য আহরণ নিয়ে দ্বন্দ্বে রয়েছেন। নবেম্বর মাস থেকেই সাগর শান্ত থাকার সুযোগে বঙ্গোপসাগরের সাতটি ফিশিং গ্রাউন্ড থেকে সহস্রাধিক ছোট বড় নৌযানে লক্ষাধিক জেলে মৎস্য আহরণে নেমে পড়ার কথা।
×