ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

৫ বছরে কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে ১২৩ শতাংশ

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ৩০ অক্টোবর ২০১৪

৫ বছরে কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে ১২৩ শতাংশ

রহিম শেখ ॥ দেশের অর্থনীতির আকার বৃদ্ধিতে কোটিপতির সংখ্যাও বেড়েছে। পাঁচ বছর আগে ব্যক্তি পর্যায়ে কোটিপতির নামে ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা ছিল ২৩ হাজার ১৩০টি। চলতি বছরের জুন শেষে এ সংখ্যা বেড়ে ৫১ হাজার ৫৫০টিতে দাঁড়িয়েছে। ৫ বছরের ব্যবধানে এ তালিকায় নতুন ২৮ হাজার ৪২০টি হিসাব যুক্ত হয়েছে। ৫ বছরে ব্যাংকগুলোতে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ১২৩ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের তফসিলি ব্যাংকগুলোর পরিসংখ্যানে এক কোটি টাকার বেশি আমানত রয়েছে এমন ব্যক্তির হিসাব (ব্যাংক এ্যাকাউন্ট) ধরে এ প্রতিবেদনে কোটিপতি গণ্য করা হয়েছে। তবে ব্যাংকিং হিসাবের বাইরে আরও অনেক কোটিপতি রয়েছেন। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যার চেয়ে কোটিপতি ঋণ গ্রহীতার সংখ্যা বেশি। বর্তমানে ব্যাংকিং খাতের মোট ঋণ প্রবাহের ৭০ শতাংশেরও বেশি ঋণ কোটিপতিদের দখলে। অর্থাৎ ৪০ শতাংশ আমানতকারী মোট ঋণপ্রবাহের ৭০ শতাংশের বেশি নিয়ন্ত্রণ করছেন। ব্যাংকিং খাত সংশ্লিষ্টদের মতে, সাধারণ আমানতকারীদের অধিকাংশই ব্যাংকে টাকা রাখেন সঞ্চয়ের জন্য, অন্যদিকে কোটিপতি গ্রাহকদের ক্ষেত্রে সঞ্চয়ের চেয়ে ঋণ গ্রহণের প্রবণতাই বেশি। শুধু দেশের সব তফসিলি ব্যাংকে আমানতকারীদের তথ্যের ভিত্তিতে এই তালিকা তৈরি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কেউ অবৈধভাবে বেনামে একাধিক হিসাবে টাকা রাখলে তাদের শনাক্ত করা কঠিন। কাজেই কোটিপতি হিসাবের প্রকৃত সংখ্যা বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবের তুলনায় অনেক বেশি। এছাড়া দেশের এমন অনেক কোটিপতি রয়েছে যাদের ব্যাংকে কোটি টাকা নেই কিন্তু কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি রয়েছে। তাদের নাম বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকাশিত তালিকায় স্থান পায়নি বলে তারা মনে করছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জুন শেষে বিভিন্ন ব্যাংকে কোটি টাকার উপরে ৫১ হাজার ৫৫০টি হিসাবে মোট আমানতের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৬০ হাজার ৭৫৮ কোটি টাকা। যা মোট আমানতের ৪০ দশমিক ১৫ শতাংশ। ২০০৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর বিভিন্ন ব্যাংকে ২৩ হাজার ১৩০টি হিসাবে কোটিপতির মোট আমানতের পরিমাণ ছিল এক লাখ ৫৪৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে এক কোটি থেকে ৫ কোটি টাকার হিসাব রয়েছে ৪১ হাজার ২৭৫টি। এসব হিসাবে আমানতের পরিমাণ ৮৪ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা। মোট আমানতের ১৩ শতাংশ। এর পরেই ৫০ কোটি বা তদুর্ধ ৪৯৪টি হিসাবে আমানতের পরিমাণ ৬২ হাজার ১৩০ কোটি টাকা। এটি মোট আমানতের ৯ দশমিক ৫৭ শতাংশ। এছাড়া ৫ কোটি থেকে ১০ কোটি টাকার ৬ হাজার ৬৭টি হিসাবে আমানতের পরিমাণ ৪৩ হাজার ২১৯ কোটি টাকা। যা মোট আমানতের ৬ দশমিক ৬৫ শতাংশ। এরপরে ১০ কোটি থেকে ১৫ কোটির এক হাজার ৭৩৮টি অ্যাকাউন্টের আমানতের পরিমাণ ২১ হাজার ৯৫ কোটি টাকা বা ৩ দশমিক ২৫ শতাংশ। ১৫ থেকে ২০ কোটি টাকার ৮৪০টি হিসাবে আমানত রয়েছে ১৪ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা বা ২ দশমিক ৩৩ শতাংশ। একইভাবে ২০ থেকে ২৫ কোটি টাকার ৩৮৩টি হিসাবে আমানত রয়েছে ৮ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা বা ১ দশমিক ৩৩ শতাংশ। ২৫ কোটি থেকে ৩০ কোটি টাকার ২৭৩টি হিসাবে ৭ হাজার ৬০১ কোটি, ৩০ কোটি থেকে ৩৫ কোটি টাকার ১৮২টি হিসাবে ৫ হাজার ৯২৯ কোটি, ৩৫ কোটি থেকে ৪০ কোটি টাকার ১১১টি হিসাবে ৪ হাজার ১৯৪ কোটি ও ৪০ থেকে ৫০ কোটি টাকার ১৮৭টি হিসাবে ৮ হাজার ৫৬২ কোটি টাকার আমানত রয়েছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক ম. মাহফুজুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, দেশের অর্থনীতির ক্রমাগত উন্নতি হয়েছে। এতে স্বাভাবিকভাবে ধনীর সংখ্যা বেড়েছে। মানুষের অর্থ বাড়ায় বেশি পরিমাণে ভোগ করছে। এটা খুবই ইতিবাচক। তিনি আরও বলেন, গ্রাহকের হিসেবে বিপুল পরিমাণের এ অর্থ থাকলেও তা অলস নয়। ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের একটি সময়ে এসে হিসাবে টাকা রাখতে বলে। সে হিসাবে নির্দিষ্ট ওই দিনে এ পরিমাণের অর্থ সংশ্লিষ্ট হিসাবে থেকেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, ১৯৭২ সালে দেশে কোটিপতি হিসাবধারী ছিলেন মাত্র পাঁচজন। ১৯৭৫ সালের ডিসেম্বর শেষে এ সংখ্যা ৪৭-এ পৌঁছায়, যা ১৯৮০ সালের ডিসেম্বরে ছিল ৯৮ জন। তখন তাদের আমানতের পরিমাণ ছিল সামগ্রিক ব্যাংকিং খাতের মোট আমানতের ১০ শতাংশ। ১৯৯০ সালে কোটিপতি আমানতকারীর হিসাবের সংখ্যা ছিল ৯৪৩টি। আর তাঁদের আমানতের পরিমাণ ছিল ব্যাংক খাতের মোট আমানতের ১২ শতাংশ। ২০০১ সালের শেষে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা হয় পাঁচ হাজার ৭৯৯টি। ব্যাংক খাতে তাঁদের অবদান হয় সাড়ে ২২ শতাংশ। একই ভাবে ‘৯০ সালে কোটিপতি ঋণ গ্রহীতার হিসাবে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২ হাজার ১২৫টিতে এবং গৃহীত ঋণের পরিমাণ ছিল মোট ঋণ প্রবাহের ৩৮ শতাংশ। এরপর অক্টোবর ২০০১ থেকে ডিসেম্বর ২০০৬ পর্যন্ত কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছিল ৮ হাজার ৮৮৭ জন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দু’বছরে বেড়েছিল ৫ হাজার ১১৪ জন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর বাইরে আরও কয়েক লক্ষাধিক রয়েছেন কোটি টাকার সম্পদের মালিক। এদের কোটি টাকার বাড়ি আছে, গাড়ি আছে এমনকি নগদ টাকাও আছে কোটি টাকার ওপরে। যারা ব্যাংকের বাইরে আমানত রেখেছেন। বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ডেভেলপার কোম্পানিসহ নানা ধরনের কোম্পানিতেও রয়েছে কোটি কোটি টাকার আমানত। এদের অধিকাংশই কর ফাঁকি দিতে তথ্য গোপন করেছেন। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে গত চার দশকে কোটিপতির সংখ্যা বৃদ্ধির চিত্র পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, প্রতিবছরে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা বেড়েছে দুই থেকে তিন গুণ। এ প্রসঙ্গে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ সিপিডি’র অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. গোলাম মোয়াজ্জেম জনকণ্ঠকে বলেন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও শিল্পায়নে দেশে কোটিপতিদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে, এটি ইতিবাচক। তবে কারা এসব বিত্তের মালিক হচ্ছেন এবং এর ফলে আর্থিক বৈষম্য বাড়ছে কি-না তার ওপর গবেষণা হওয়া দরকার। সেই সঙ্গে কোটিপতিদের কাছ থেকে যথাযথভাবে রাজস্ব আদায় নিশ্চিত করা দরকার।
×