ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রূপান্তর হচ্ছে ডুয়েলগেজে;###;নির্মাণ ব্যয় বাড়ছে ৬ হাজার ৩৮৬ কোটি টাকা;###;নির্মাণ ব্যয় নিয়ে আপত্তি তুলেছে সংসদ কমিটি

বিশ্বরোডে রেল সংযোগ ॥ দোহাজারী-গুনধুম রেলপথ নির্মাণে ব্যয় বাড়ছে

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ৩০ অক্টোবর ২০১৪

বিশ্বরোডে রেল সংযোগ ॥ দোহাজারী-গুনধুম রেলপথ নির্মাণে ব্যয় বাড়ছে

মশিউর রহমান খান ॥ চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার হয়ে মিয়ানমারের গুনধুম পর্যন্ত ১২৮ কিলোমিটার মিটারগেজ রেলপথটি নির্মাণের আগেই ব্যয় বাড়ছে প্রায় ৬ হাজার ৩৮৬ কোটি টাকা। এ ব্যয় পূর্বের নির্মাণ ব্যয়ের চেয়ে প্রায় ৩৫০ শতাংশ বেশি। তথ্য মিটারগেজ রেলপথ নির্মাণে প্রকল্প ব্যয় ধরা হয় ১ হাজার ৮৫২ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। গত ৪ বছরের বেশি সময়েও রেলপথটি নির্মাণে কোন অগগ্রগতি না হলেও নতুন করে নির্মাণ ব্যয়ের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের ফলে এ ব্যয় ধরা হয়েছে বলে সুত্র নিশ্চিত করেছে। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী সম্প্রতি দেশের সকল রেলপথ ডুয়েলগেজে রূপান্তরের মাধ্যমে ট্রান্স এশিয়ান তথা বহির্বিশ্বের সঙ্গে রেলের সংযোগ স্থাপনের লক্ষ্যে এ রেলপথটি ডুয়েলগেজে পরিবর্তন করে নির্মাণের নির্দেশ দেন। এতে নির্মাণ ব্যয় প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে জানা গেছে। তবে প্রকল্পটির এ নির্মাণ ব্যয় নিয়ে এরই মধ্যে আপত্তি তুলেছে রেলপথ সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। এজন্য প্রকল্পটি পুনরায় জরিপ করা হচ্ছে। সূত্র জানায়, ২০১০ সালের জুলাইয়ে চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার হয়ে মিয়ানমারের গুনধুম সীমান্ত পর্যন্ত রেলপথটি নির্মাণের প্রকল্পটি অনুমোদন করে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। মিটারগেজ রেলপথ নির্মাণে প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয় ১ হাজার ৮৫২ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। গত ৪ বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গিয়ে নানা জটিলতায় বাস্তবায়ন বিলম্বের কারণে সম্প্রতি নতুন করে সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়। এর ভিত্তিতে ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ২৩৮ কোটি টাকা। রেলসুত্র জানায়, নতুন হিসাব মতে রেলপথটি নির্মাণে কিলোমিটার প্রতি ব্যয় পড়ছে ৬৪ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। অথচ চলমান টঙ্গী-ভৈরববাজার ডাবল লাইন প্রকল্পে কিলোমিটার প্রতি ব্যয় হচ্ছে ৩১ কোটি ৮২ লাখ টাকা। আর লাকসাম-চিনকি আস্তানা ডাবল লাইন প্রকল্পে কিলোমিটার প্রতি ব্যয় ২১ কোটি ১৮ লাখ টাকা। রেল সংশ্লিষ্টদের মতে, রেলপথটি নির্মাণে নতুন করে করা সম্ভাব্য ব্যয় তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি ধরা হয়েছে। সূত্র জানায়, নির্মাণ ব্যয় বাড়লেও প্রকল্পটির অর্থায়নের উৎস নির্ধারিত হয়নি। বিদেশী সহায়তায় রেলপথটি নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়া হলেও এখনও চূড়ান্ত কোন প্রস্তাব পাওয়া যায়নি। ২০১০ সালে একনেকে অনুমোদনের সময় এডিবি প্রকল্পটিতে অর্থায়নের প্রস্তাব দিয়েছিল। তবে ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় এডিবি অর্থায়ন করবে কি না তাও নিশ্চিত নয়। সংশ্লিষ্টরা জানান, দোহাজারী-কক্সবাজার-গুনধুম মিটারগেজ রেলপথ নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে তা ডুয়েলগেজ লাইন করা হচ্ছে। এতে পুনরায় ব্যয় বাড়তে যাচ্ছে। ডুয়েলগেজ রেলপথ নির্মাণের ক্ষেত্রে ব্যয় ১০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। ২০১৩ সালে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে দোহাজারী-কক্সবাজার-ঘুনদুম রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা যাচাই শুরু করা হয়। ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে এ কাজ করে কানাডার পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ক্যানারেল কোম্পানি। এতে সহায়তা করে জার্মানির ডিবি ইন্টারন্যাশনাল, অস্ট্রেলিয়ার স্ম্যাক ও বাংলাদেশের এসিই কনসালট্যান্ট। চলতি বছর জানুয়ারিতে মাঠ পর্যায়ের কাজ শেষ হয়। আর প্রতিবেদন জমা দেয়া হয় সেপ্টেম্বরে। এতে ব্যয় বৃদ্ধির বিষয়টি উঠে আসে। রেলসূত্রে জানা গেছে, এডিবি প্রাথমিকভাবে আগ্রহ দেখালেও এখনও অর্থায়নের কোন নিশ্চিত উৎস চূড়ান্ত হয়নি। মিয়ানমার হয়ে চীনের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে রেলপথটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এতে চীনও এ প্রকল্পে অর্থায়ন করতে পারে। তবে কিছুই এখনও চূড়ান্ত নয়। রেলওয়ের তথ্যমতে, দোহাজারী-কক্সবাজার-ঘুনদুম প্রকল্পের বাস্তবায়নকাল ছিল ২০১০ সালের জুলাই থেকে ২০১৩ সালের ডিসেম্বর। পরে দুই দফা সময় বাড়িয়ে ২০১৫ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদ নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু এখনও প্রকল্পের বাস্তব অগ্রগতি প্রায় শূন্যের কোটায়। জানা গেছে, প্রকল্প সংশোধনের পর ২০১৬ সালের আগে নির্মাণকাজ শুরু করা যাবে না। আর বাস্তবায়নে লাগবে কমপক্ষে ৪ বছর । ফলে ২০১৯ সালে রেলপথটি নির্মাণ শেষ হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বর্তমানে পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের আওতাধীন চট্টগ্রামের দোহাজারী পর্যন্ত রেললাইন আছে। কক্সবাজারে পর্যটক ভ্রমণ ও মানুষ আসা-যাওয়ায় সড়কপথ এবং বিমান যোগাযোগ থাকলেও রেলপথ নেই। এছাড়া ট্রান্স-এশিয়ান রেলপথ চালু করতে মিয়ানমারের ঘুনদুম সীমান্ত পর্যন্ত ট্রেন সংযোগ দরকার। তাই ১২৮ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণের এ উদ্যোগ নেয়া হয়। প্রকল্পটির আওতায় দোহাজারী থেকে রামু ৮৮ কিলোমিটার, রামু থেকে কক্সবাজার ১২ কিলোমিটার এবং রামু থেকে ঘুনদুম পর্যন্ত ২৮ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণের কথা ছিল। এছাড়া সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, চকরিয়া, ডুলাহাজারা, ঈদগাহ, রামু, কক্সবাজার, উখিয়া ও ঘুনদুম রেলস্টেশন নির্মাণ এবং কম্পিউটারবেজড ইন্টারলক সিগন্যালিং সিস্টেম, চারটি প্রধান ও ৪৩ ছোট রেল সেতু এবং ১৪৪ লেভেলক্রসিংসহ আনুষঙ্গিক বিভিন্ন নির্মাণকাজ করার কথা ছিল। সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রকল্পের জন্য চট্টগ্রাম জেলায় ৩৬০ দশমিক ৩৬ একর এবং কক্সবাজার জেলায় ১ হাজার ৫১ দশমিক ১৫ একর ভূমি অধিগ্রহণের জন্য জেলা প্রশাসকদের জানানো হয় ২০১০ সালের ডিসেম্বরে। পুরো প্রকল্পের ১ হাজার ৪১১ দশমিক ৫১ একর ভূমি অধিগ্রহণ বাবদ ৩১২ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছিল। ২০১০-১১ অর্থবছরে বরাদ্দ পাওয়া ১০ কোটি টাকার মধ্যে ৯ কোটি ৭৫ লাখ চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক বরাবর ভূমি অধিগ্রহণের জন্য দেয়া হয়। কিন্তু জমির দাম বেড়ে যাওয়ায় ২০১১ সালে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন থেকে অধিগ্রহণের জন্য প্রকল্প পরিচালকের কাছে চাওয়া হয় ৩৯১ কোটি টাকা। এর পর ২০১২ সালে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন থেকে অধিগ্রহণের জন্য চাওয়া হয় ৩১৪ কোটি টাকা। এ অবস্থায় ভূমি অধিগ্রহণের জন্য ব্যয় আড়াই থেকে ৩ বছর আগেই বেড়ে দাঁড়ায় ৭০৫ কোটি টাকা। সূত্র জানায়, রেলপথটি নির্মাণের এলাইনমেন্টে কক্সবাজারের ডুলাহাজারায় অবস্থিত খ্রীস্টান মেমোরিয়াল হাসপাতালের কিছু জায়গা রয়েছে। তাদের আপত্তিসহ জমি অধিগ্রহণে বেশকিছু মানুষের আপত্তির মুখে ২০১২ সালের ৪ অক্টোবর রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সভায় জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়ার কার্যক্রম স্থগিত করা হয়। সেই স্থগিতাদেশ এখনও প্রত্যাহার করা হয়নি। শেষ পর্যন্ত হাসপাতালের জায়গা ছেড়ে দিয়ে দিক পরিবর্তন করে রেললাইন নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। রেলসূত্র জানায়, জমি অধিগ্রহণে ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় প্রকল্পটির নির্মাণ ব্যয় বাড়ছে। এর মধ্যে জমি অধিগ্রহণে ব্যয় হবে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা। বাকি অর্থ নির্মাণকাজে ব্যয় করা হবে। আর ২০১৯ সালে এটি নির্মাণ সম্পন্ন হতে পারে।
×