ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বদর প্রধানের ফাঁসি

প্রকাশিত: ০৪:৩৬, ৩০ অক্টোবর ২০১৪

বদর প্রধানের ফাঁসি

০ ‘এ অপরাধের পরেও যদি ফাঁসি না দেয়া হয়, তাহলে তা হবে বিচারের ব্যর্থতা’- নিজামীর অপরাধ প্রসঙ্গে ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ০ ইসলামী ছাত্রসংঘ, আলবদর বাহিনী শুধু ক্রিমিন্যাল অর্গানাইজেশনই নয় কম্যুনাল অর্গানাইজেশনও বিকাশ দত্ত একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনক্সা বাস্তবায়ন, হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন সম্পত্তি ধ্বংস, দেশত্যাগে বাধ্য করায় আলবদর বাহিনীর প্রধান বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সাবেক মন্ত্রী ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলার রায়ে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামি জামায়াতে ইসলামীর বর্তমান আমির মতিউর রহমান নিজামীকে ফাঁসির আদেশ দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল। মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ১৬টি অভিযোগের মধ্যে ৮টি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। ৪ অভিযোগে তাঁকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ-ের আদেশ দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল। অপর ৪টি অভিযোগে তাকে যাবজ্জীন কারাদ- দেয়া হয়েছে। বাকি ৮টি অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তাকে খালাস দেয়া হয়েছে। ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান রায়ে বলেন, এই অপরাধের পরও যদি ফাঁসি না দেয়া হয়, তাহলে তা হবে বিচারের ব্যর্থতা। বিচারপতি চেয়ারম্যান এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বে তিন সদস্য বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুাল-১ ভাবগাম্ভীর্য পরিবেশে জনাকীর্ণ আদালতে পিনপতন নীরবতার মধ্য দিয়ে বুধবার এই ঐতিহাসিক রায় প্রদান করেন। ট্রাইব্যুনালে অন্য দু’ সদস্য ছিলেন বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম ও বিচারপতি আনোয়ারুল হক। রায়কে ঘিরে ট্রাইব্যুনালে নেয়া হয়েছিল সর্বকালের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা। রায় ঘোষণার পর প্রসিকিউশন পক্ষ সন্তোষ প্রকাশ করে বলেছে, এটি একটি ঐতিহাসিক রায়। নিজামীর মামলায় দেয়া রায় অন্যান্য সাম্প্রদায়িক সংগঠনকে বিচারের আওতায় আনার ক্ষেত্রে একটি ‘মডেল’ হিসেবে কাজ করবে। অন্যদিকে আসামি পক্ষ বলেছে, রায়টি অত্যন্ত দুর্বল। ন্যায়বিচার পাইনি। আমরা এ রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করব। আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আনিসুল হক তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “আদালত যে রায় দিয়েছে তাতে আমি ব্যক্তিগতভাবে সন্তুষ্ট। সরকারও এ রায়ে সন্তুষ্ট। রায় আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য এবং ত্বরিত কার্যকর করতে পদক্ষেপ নেবে সরকার। এখন আমরা যে চেষ্টা করব তা হলো- আপীলের তাড়াতাড়ি শুনানি করে ট্রাইব্যুনালের রায় বহাল রেখে তা কার্যকর করা। সকাল থেকে ট্রাইব্যুনালের সামনে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড, মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ড, মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম লীগ অবস্থান নেয়। তারা সকাল থেকে অবস্থান নিয়ে মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির দাবিতে সেøাগান দিতে থাকে। রায় ঘোষণার পর আনন্দ মিছিল করে। এ দিকে মতিউর রহমান নিজামীর রায় ঘোষণার পর এখনও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ৫টি মামলা রায় ঘোষণার জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখা হয়েছে। রায় ঘোষণার অপেক্ষায় ৫ মামলার মধ্যে রয়েছে মীর কাশেম আলী, এটিএম আজাহারুল ইসলাম, জাহিদ হোসেন খোকন, সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সার ও মোঃ মোবারক হোসেন। ট্রাইব্যুনাল রায় ঘোষণার আগে চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম প্রারম্ভিক বক্তব্যে বলেন, ‘এই দীর্ঘ অপেক্ষার কারণে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মহল ও গণমাধ্যমে নানা ধরনের কথা হয়েছে। বিচারক হিসেবে সেসব কথা আমলে নেয়ার কিংবা জবাব দেয়ার সুযোগ আমাদের নেই। আদালত রাস্তায় গিয়ে কিংবা টকশোতেও অংশ নিয়ে কথা বলতে পারে না। আমরা বোবার মতো থাকি। তাই সবাইকে আইন, সংবিধান, আদালত নিয়ে কথা বলার সময় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। আমাদের যতই অভিযুক্ত করেন না কেন, আমরা কোন জবাব দিতে পারব না। আমাদের সামনে সংবিধানের নির্দেশ ছাড়া আর কারও নির্দেশ নেই। আমরা কারও সঙ্গে আপোস করি না, সমঝোতা করি না। আমাদের আপোস সমঝোতা আইন, সাক্ষ্য-প্রমাণ ও সংবিধানের সঙ্গে। আর রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, নিজামী একাত্তরে ছাত্রসংঘের সভাপতি থাকা অবস্থায় তার সঙ্গে আলবদর বাহিনী গঠন করে তার প্রধান হন। প্রধান হিসেবে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান বর্তমান বাংলাদেশ বিভিন্ন জায়গায় বক্তৃতা বিবৃতি দিয়ে আলবদর বাহিনী ও রাজাকার বাহিনী গঠন করে গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধসমুহ করেন। নিজামী শুধু আলবদর বাহিনীর প্রধানই ছিলেন না, তিনি এই বাহিনী গঠনের ক্ষেত্রেও মূল নেতৃত্বে ছিলেন। এছাড়া ১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৭১ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিনি নিখিল পাকিস্তান ছাত্রসংঘের সভাপতি ছিলেন। বর্তমানে যা ছাত্রশিবির নামে পরিচিত। ছাত্রসংঘের এ্যাকশন সেকশন ছিল আলবদর বাহিনী। নিজামীর দৃঢ় নিয়ন্ত্রণ ও নেতৃত্ব ছিল ছাত্রসংঘ ও আলবদর বাহিনীর ওপর। আলবদর একটি ক্রিমিনাল সংগঠন তো বটেই, একইসঙ্গে এটি একটি সাম্প্রদায়িক সংগঠনও। সে সময় ধর্মের অপব্যাখ্যা করে প্রচুর তরুণকে এ সংগঠনটি বিভ্রান্ত করেছিল। যাদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন নিজামী। ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম ॥ বুধবার সকাল থেকে ট্রাইব্যুনাল অঙ্গনে সাংবাদিক, আইনজীবী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ভিড় ছিল লক্ষণীয়। সকাল ১১টায় মতিউর রহমান নিজামীকে এজলাস কক্ষে আনা হয়। ১১টা ৫ মিনিটে ট্রাইব্যুনালে রায় ঘোষণার জন্য চেয়ারম্যানসহ অন্য দু’ বিচারপতি আসন গ্রহণ করেন। ১১টা ৬ মিনিটে চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম প্রারম্ভিক বক্তব্য রাখেন। রায়ে মামলার অভিযোগের অংশ বিচারপতি আনোয়ারুল হক, পর্যবেক্ষণ অংশ বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন শাহীন এবং রায় ও দ-ের অংশ উপস্থাপন করেন ট্রাইব্যুনাল-১-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম। বিমর্ষ নিজামী ॥ সকাল ১১টায় আসামি মতিউর রহমান নিজামীকে ট্রাইব্যুনালে ডকে তোলা হয়। এর আগে ঢাকা কারাগার থেকে সকাল নয়টা ২০ মিনিটে নিজামীকে পুলিশের কড়া প্রহরায় ট্রাইব্যুনালের হাজতখানায় আনা হয়। নিজামীকে হাজতখানা থেকে ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় আনা হয়। কাঠগড়ায় তাঁকে বিমর্ষ দেখাচ্ছিল। এ সময় তাঁর পরনে ছিল সাদা পাজামা ও পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবির ওপরে ছিল খয়েরি রঙের কোটি। আর মাথায় জিন্নাহ টুপি। রায় ঘোষণার পর যখন নিজামীকে ট্রাইব্যুনালের ডক থেকে নিচ তলায় হাজতখানায় নেয়া হয় তখনও তিনি ছিলেন শান্ত ও বিমর্ষ। রায় ঘোষণার সময় তিনি বিচারকের দিকে তীক্ষè দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন। যে অভিযোগে ফাঁসি ॥ মতিউর রহমান নিজামীকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার অভিযোগ ২, ৪, ৬ ও ১৬ নম্বর ঘটনায় বুদ্ধিজীবী গণহত্যা, হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, সম্পত্তি ধ্বংস, দেশত্যাগে বাধ্য করার দায়ে নিজামীর ফাঁসির রায় হয়েছে। এই চারটি অভিযোগের মধ্যে রয়েছেÑ অভিযোগ-২: পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার বাউশগাড়ি গ্রামের রূপসী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটি সভা হয়। স্থানীয় শান্তি কমিটির সদস্য ও রাজাকারদের উপস্থিতিতে ওই সভায় নিজামী বলেন, শীঘ্রই পাকিস্তানী সেনারা শান্তি রক্ষার জন্য আসবে। ওই সভার পরিকল্পনা অনুসারে পরে ১৪ মে ভোর সাড়ে ৬টার দিকে বাউশগাড়ি, ডেমরা ও রূপসী গ্রামের প্রায় সাড়ে ৪০০ মানুষকে পাকিস্তানী সেনারা হত্যা করে। প্রায় ৩০-৪০ জন নারীকে সেদিন ধর্ষণ করে পাকিস্তানী সেনা ও রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা। এ ঘটনায় নিজামীর বিরুদ্ধে হত্যা, ধর্ষণ ও দেশত্যাগে বাধ্য করার অভিযোগ আনা হয়, যা ট্রাইব্যুনাল আইনের ৩ (২) (এ) ও (জি), ৪ (১), ৪ (২) এবং ২০ (২) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অভিযোগ-৪: নিজামীর নির্দেশনা ও পরিকল্পনায় রাজাকার বাহিনী পাবনার করমজা গ্রামে হাবিবুর রহমান নামে একজনকে হত্যা করে। ১৯৭১ সালের ৮ মে নিজামীর রাজাকার ও আলবদর বাহিনী ওই গ্রাম ঘিরে ফেলে নয় জনকে হত্যা করে। রাজাকার বাহিনী একজনকে ধর্ষণসহ বাড়িঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। এ ঘটনায় হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও সম্পত্তি ধ্বংসের অভিযোগ আনা হয় আসামির বিরুদ্ধে, যা ট্রাইব্যুনাল আইনের ৩ (২) (এ) ও (এইচ), ৪ (১), ৪ (২) এবং ২০ (২) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অভিযোগ-৬: নিজামীর নির্দেশে ১৯৭১ সালের ২৭ নবেম্বর পাবনার ধুলাউড়ি গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজতে যায় পাকিস্তানী সেনা ও তাদের দোসর রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা। তারা গ্রামের ডাঃ আবদুল আউয়াল ও তার আশপাশের বাড়িতে হামলা চালিয়ে নারী, পুরুষ ও শিশুসহ ৫২ জনকে হত্যা করে। এ ঘটনায় হত্যার অভিযোগ আনা হয় নিজামীর বিরুদ্ধে, যা ট্রাইব্যুনাল আইনের ৩ (২) (এ), ৪ (১), ৪ (২) এবং ২০ (২) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অভিযোগ-১৬: মুক্তিযুদ্ধে বাঙালীর বিজয়ের ঊষালগ্নে অসংখ্য বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করে আলবদর বাহিনী। দেশের বুদ্ধিজীবী শ্রেণীকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ধ্বংস করার জন্য পরিকল্পিতভাবে আলবদর সদস্যরা ওই গণহত্যা ঘটায়। জামায়াতের তৎকালীন ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘ ও আলবদর বাহিনীর প্রধান হিসেবে ওই গণহত্যার দায় নিজামীর ওপর পড়ে। একটি জাতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবীদের হত্যার ওই ঘটনায় গণহত্যার অভিযোগ আনা হয় নিজামীর বিরুদ্ধে, যা ট্রাইব্যুনাল আইনের ৩ (২) (সি) (আই), ৪ (১), ৪ (২) এবং ২০ (২) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যে অভিযোগে যাবজ্জীবন ॥ অপর চারটি অভিযোগ মতিউর রহমান নিজামীকে যাবজ্জীবন কারাদ- প্রদান করা হয়েছে। অভিযোগগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ অভিযোগ-১ : বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে প্রচার চালানোর কারণে একাত্তরের ৪ জুন পাকিস্তানী সেনারা পাবনা জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক মাওলানা কছিমুদ্দিনকে অপহরণ করে নূরপুর পাওয়ার হাউস ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে নিজামীর উপস্থিতিতে তাঁর ওপর নির্যাতন চালানো হয়। ১০ জুন তাঁকে ইছামতী নদীর পাড়ে আরও কয়েকজনের সঙ্গে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় আটক, নির্যাতন ও হত্যার অভিযোগ আনা হয় নিজামীর বিরুদ্ধে, যা আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন ১৯৭৩-এর ৩ (২) (এ), ৪ (১), ৪ (২) এবং ২০ (২) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অভিযোগ-৩ : মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মে মাসের শুরু থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোহাম্মদপুরের ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট ব্যবহৃত হয় পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর ক্যাম্প হিসেবে। রাজাকার ও আলবদর বাহিনীও সেখানে ক্যাম্প খুলে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকা- চালাতে থাকে। নিজামী ওই ক্যাম্পে নিয়মিত যাতায়াত ও মানবতাবিরোধী অপরাধের ষড়যন্ত্র করতেন বলে প্রসিকিউশনের অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে মানবতাবিরোধী অপরাধের ষড়যন্ত্র ও সংঘটনে সহযোগিতার অভিযোগ আনা হয় নিজামীর বিরুদ্ধে, যা ট্রাইব্যুনাল আইনের ৩ (২) (এ), (জি) ও (এইচ), ৪ (১), ৪ (২) এবং ২০ (২) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অভিযোগ-৭ : একাত্তর সালের ৩ নবেম্বর মধ্যরাতে নিজামীর দেয়া তথ্যে রাজাকার বাহিনীকে নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনী পাবনার বৃশালিখা গ্রাম ঘিরে ফেলে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল লতিফ সেলিমের বাবা সোহরাব আলীকে আটক করে। তাকে রাস্তায় নিয়ে নির্মম নির্যাতনের পর স্ত্রী ও সন্তানদের সামনেই হত্যা করা হয়।এ ঘটনায় নির্যাতন ও হত্যার অভিযোগ আনা হয় তখনকার বদর নেতা নিজামীর বিরুদ্ধে, যা ট্রাইব্যুনাল আইনের ৩ (২) (এ) ও (এইচ), ৪ (১), ৪ (২) এবং ২০ (২) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অভিযোগ-৮ : একাত্তরের ৩০ আগস্ট ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি ও আলবদর বাহিনীর প্রধান নিজামী তার সংগঠনের তখনকার সেক্রেটারি আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে সঙ্গে নিয়ে নাখালপাড়ার পুরনো এমপি হোস্টেলে যান এবং সেখানে আটক মুক্তিযোদ্ধা জহির উদ্দিন বিচ্ছু জালাল, বদি, রুমি (শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ছেলে), জুয়েল ও আজাদকে দেখে তাদের গালিগালাজ করেন। পাকিস্তানী ক্যাপ্টেনকে নিজামী বলেন, রাষ্ট্রপতির সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আদেশের আগেই তাদের হত্যা করতে হবে। নিজামীর পরামর্শ অনুযায়ী পরে জালাল ছাড়া বাকি সবাইকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় নিজামীর বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনা হয়, যা ট্রাইব্যুনাল আইনের ৩ (২) (এ), ৪ (১), ৪ (২) এবং ২০ (২) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যেসব অভিযোগ থেকে খালাস ॥ বিচারক বলেন, এই অপরাধের পরও যদি ফাঁসি না দেয়া হয়, তাহলে তা হবে বিচারের ব্যর্থতা। অপরাধে সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হওয়ায় ১, ৩, ৭ ও ৮ নম্বর অভিযোগে আটক, নির্যাতন, হত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের ষড়যন্ত্র ও সংঘটনে সহযোগিতার দায়ে জামায়াত আমিরকে দেয়া হয়েছে যাবজ্জীবন কারাদ-। বাকি আট অভিযোগ প্রসিকিউশন প্রমাণ করতে না পারায় এসব অভিযোগ থেকে নিজামীকে খালাস দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল। পর্যবেক্ষণ ॥ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আসামি মতিউর রহমান নিজামীর রায়ে কিছু পর্যবেক্ষণ প্রদান করেছেন। পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, ইসলামী ছাত্রসংঘ কিংবা আলবদর বাহিনী শুধু ক্রিমিন্যাল অর্গানাইজেশন নয়, এই সংগঠনগুলো কম্যুনাল বা সাম্প্রদায়িক অর্গানইজেশন। নিজামী ইসলাম ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত। কিন্তু ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজনীতিতে ধর্মের অপব্যবহার করেছিলেন তিনি। ১১ থেকে ১৪ নম্বর অভিযোগে মানবতাবিরোধী অপরাধে উস্কানির যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে সেগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, একাত্তরের ৩ আগস্ট চট্টগ্রাম মুসলিম ইনস্টিটিউটে ইসলামী ছাত্রসংঘের সভায় পাকিস্তানকে ‘আল্লাহর ঘর’ বলেন। স্পষ্টতই তিনি এবং তার দল জামায়াতে ইসলামী ইসলামের মূল কথার বিকৃতি ঘটিয়ে রাজনীতিতে ব্যবহার করেছেন। রাজনীতিতে ধর্মের অপব্যবহার করেছেন। রায়ের পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়েছে, নিজামীকে ২০০১ সালে মন্ত্রী বানানো ভুল ছিল। এটাকে একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের গালে চড় মারার শামিল। আলবদর বাহিনী সম্পর্কে ট্রাইব্যুনাল বলেন, নিজামী শুধু আলবদর বাহিনীর প্রধানই ছিলেন না, এটি গঠনের ক্ষেত্রেও তার অনেক ভূমিকা ছিল। আলবদর বাহিনী ছিল ছাত্রসংঘের ‘এ্যাকশন সেকশন।’ স্পষ্টতই ছাত্রসংঘ ও আলবদরের ওপরে নিজামীর দৃঢ় নিয়ন্ত্রণ ছিল। নিজামী মনপ্রাণ দিয়ে শুধু বাংলাদেশের বিরোধিতাই করেননি, তিনি পরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবী হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বুদ্ধিজীবী ডাঃ আলীম চৌধুরী, আজহারুল হক ও হুমাযুন কবিরের হত্যাকা-ের সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতা সাক্ষ্যের মাধ্যমে প্রমাণ হয়েছে। জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী রায় হয়েছে বলেও মনে করে ট্রাইব্যুনাল। আপোস করি না ॥ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর রায় ঘোষণার আগে প্রারম্ভিক বক্তব্য রাখেন। চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম তাঁর বক্তব্যে বলেন, আপনারা দীর্ঘদিন ধরে রায়ের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন। আমরাও অপেক্ষায় ছিলাম। কখন এই রায় দিতে পারব দীর্ঘ অপেক্ষার কারণে বিভিন্ন মহল এবং গণমাধ্যম নানা কথা বলেছেন। বিচারক হিসেবে আমলে নেয়ার সুযোগ নেই। জবাবেরও কোন সুযোগ নেই। ন্যায়বিচারের মূল কথা হলো ‘নো অন শুড বি কনডেমড’ (না শুনে কাউকে দোষ দেয়া উচিত নয়)। আদালত রাস্তায় যেতে পারে না। আমরা টকশোতেও পারটিসিপেট করতে পারি না। আদালতের বিচারক সম্পর্কে কথা বলতে হলে মনে রাখা দরকার আমরা বক্তব্য বিবৃতি দিতে পারি না। আমাদের কাছে নির্দেশ নেই। কারও সঙ্গে আপোস করিনি, সমঝোতা করিনি। প্রশ্ন ওঠার সুযোগ নেই ॥ আইনমন্ত্রী এ্যাডভেকেট আনিসুল হক তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, অন্য কোন অভিযোগ না থাকলেও শুধু বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়েই নিজামীর মৃত্যুদ-প্রাপ্য। দ্রুত রায় কার্যকর করার জন্য যা করণীয় তার সবকিছুই করবে সরকার। রায় নিয়ে প্রশ্ন ওঠার কোন সুযোগ নেই। ট্রাইব্যুনাল তার ‘এখতিয়ারের বাইরে’ বক্তব্য দিয়েছে বলে আসামি পক্ষের আইনজীবীর অভিযোগ নাকচ করে আইনমন্ত্রী বলেন, বিচার বিভাগ স্বাধীন। ট্রাইব্যুনালের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্নই ওঠে না। তারা আইন অনুযায়ী সাজা দিয়েছেন। সরকারের পক্ষ থেকে প্রসিকিউশনকে যতটুকু সাহায্য করা উচিত ততটুকু করেছে। অপরাধীর শাস্তি হয়েছে ॥ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশন পক্ষ এ রায়ে খুশি। চীফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু বলেছেন, আসামি অপরাধ করেছে, অপরাধীর শাস্তি হয়েছে। প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী বলেছেন, আমরা যুক্তিতর্কে নিজামীর বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো প্রমাণ করতে পেরেছি। এ রায়ে আমরা খুশি। প্রসিকিউটর মোহাম্মদ আলী বলেছেন, নিজামীকে মৃত্যুদ- সাজাকে একটি ‘ঐতিহাসিক রায়’। ‘নিজামীর বিরুদ্ধে ১৬টি অভিযোগের মধ্যে ৮টা অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে প্রসিকিউশন পক্ষ। প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ সাংবাদিকদের বলেছেন, মতিউর রহমান নিজামীর মামলায় দেয়া রায় অন্যান্য সাম্প্রদায়িক সংগঠনকে বিচারের আওতায় আনার ক্ষেত্রে একটি ‘মডেল’ হিসেবে কাজ করবে। ১৯৭১ এর বাস্তবতায় এ ধরনের সংগঠনের বিচারে সুবিধা হবে। ট্রাইব্যুনালে নিরাপত্তা ॥ মতিউর রহমান নিজামীর রায়কে ঘিরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে নেয়া হয় কঠোর নিরাপত্তা। ট্রাইব্যুনালের প্রধান ফটকে আইডি কার্ড নিয়ে প্রথমে চেকিং করে ট্রাইব্যুনাল এলাকায় প্রবেশ করতে দেয়া হয়। এর পর মূল ভবনে প্রবেশ করতে তিন বার চেকিং এর পর সংবাদ কর্মীসহ অন্যদের প্রবেশ করতে দেয়া হয়। হাইকোর্ট ও ট্রাইব্যুনালের ভেতরে প্রবেশের সময় সকলের দেহ তল্লাশি করা হয়। নিরাপত্তার জন্য দোয়েল চত্বর থেকে হাইকোর্টের মাজার পর্যন্ত চলাচলের রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। পুলিশের সাঁজোয়া যানও সেখানে অবস্থান নেয়। ডাবল ফাঁসি ॥ জামায়াত নেতা নিজামীর ট্রাইব্যুনালের মৃত্যুদ- দেয়ার আগে আরেকটি আদালত মৃত্যুদ- প্রদান করে। এ নিয়ে তাকে ডাবল ফাঁসির আদেশ দেয়া হলো। ৩০ জানুয়ারি চট্টগ্রামের ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় নিজামীসহ ১৪ জনের মৃত্যুদ-ের আদেশ দেয় আদালত। ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল রাতে চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড বা সিইউএফএল জেটিঘাটে ধরা পড়ে ১০ ট্রাক অস্ত্র। এই অস্ত্র আটক মামলায় ৫০ জনকে আসামি করা হয়। নিজামী ঘটনার সময় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শিল্পমন্ত্রী ছিলেন। ট্রাইব্যুনালের দশম রায় ॥ মতিউর রহমান নিজামীর রায়টি হলো আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দশম রায়। আর ট্রাইব্যুনালের-১ এর চতুর্থ রায়। আগে নয়টি মামলার রায় হয়েছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক রুকন বাচ্চু রাজাকার (মৃত্যুদ-), জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লা (যাবজ্জীবন) আপীলে (ফাঁসি), জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী (মৃত্যুদ-) আপীলে (আমৃত্যু কারাদ-), সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামান (মৃত্যুদ-), সাবেক আমির গোলাম আযম (৯০ বছরের কারাদ-), জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ (মৃত্যুদ-), বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও চট্টগ্রামের সাংসদ সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী (মৃত্যুদ-), বিএনপির সাবেক মন্ত্রী আবদুল আলীম (আমৃত্যু কারাদ-) ও বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মঈনুদ্দীন (মৃত্যুদ-)।
×