ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

যেখানেই নারী নির্যাতন সেখানেই প্রতিরোধ গড়তে হবে ॥ তথ্যমন্ত্রী

প্রকাশিত: ০৬:৪৬, ২৯ অক্টোবর ২০১৪

যেখানেই নারী নির্যাতন সেখানেই প্রতিরোধ গড়তে হবে ॥ তথ্যমন্ত্রী

নারীর জন্য নিরাপদ নগরী শীর্ষক ক্যাম্পেন স্টাফ রিপোর্টার ॥ নারী নির্যাতন আইনের বাস্তবায়ন না হলে নগরী কখনও নারীর জন্য নিরাপদ হবে না। এজন্য সরকারকে নিতে হবে জিরো টলারেন্স নীতি। এই সামাজিক ব্যাধি দূর করতে বড়বড় শহরে সিটি গর্বনেন্স দেয়া উচিত। এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করতে হবে। তাদের আইনী ক্ষমতাও বাড়াতে হবে বলে মত দিয়েছেন বিশিষ্টজনরা। মঙ্গলবার রাজধানীর স্পেক্ট্রা কনভেনশন সেন্টারে ‘নারীর জন্য নিরাপদ নগরী’ শীর্ষক ক্যাম্পেনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন তারা। অনুষ্ঠানে এ বিষয়ে এ্যাকশন এইড বাংলাদেশের জরিপের এই ফল তুলে ধরা হয়। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেন, নারী যে নগরজীবনে নিরাপদ নয় সেটি এই গবেষণায় ফুটে উঠেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঠিক নজরদারির ঘাটতি, সচেতনতার অভাব, আইন বা নীতির সঠিক বাস্তবায়ন হলে হয়ত এই পরিস্থিতির উন্নতি হতো। তিনি বলেন, নারী নির্যাতনে পুলিশ সঠিকভাবে কাজ করে না, অনেকাংশে এটা ঠিক। এজন্য পুলিশকে জেন্ডার বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। তিনি আরও বলেন, নারীরাও নির্যাতনের শিকার হলে চুপ থাকেন। এখন আর চুপ করে থাকার সময় নেই। নারীদেরই প্রতিবাদ করতে হবে। যারা নারী নির্যাতনকারীদের জানোয়ারের সঙ্গে তুলনা করে মন্ত্রী বলেন, যেখানেই নির্যাতন সেখানেই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেন, ২০২৫ সালের মধ্যে দেশের অর্ধেক মানুষ শহরে বাস করবে; যাদের অর্ধেক থাকবে নারী। এ সময় প্রায় ৪ কোটি নারী শহরে বাস করবে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, নারী নির্যাতন প্রতিরোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও কঠোর হতে হবে। অনুষ্ঠানে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরশনের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভি বলেন, নারীকে দোষারোপ করার মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। নারীকে প্রতিবাদ করতে হবে। আমাদের কিসের লজ্জা। লজ্জা তো থাকবে তাদের যারা নারীকে উত্ত্যক্ত করে। একজন উত্ত্যক্তের শিকার হলে অন্যদের এগিয়ে আসতে হবে। তিনি বলেন, সমাজে নৈতিকতার অবক্ষয় হচ্ছে। স্কুলে এখন ইয়াবা ও মাদকের ছড়াছড়ি। মাদকের কারণে মায়েরা এখন বাচ্চাদের স্কুলে পাঠাতে ভয় পান। অথচ পুলিশ যেন চোখে আঙ্গুল দিয়ে বসে আছে। থানার ওসিদের নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সক্রিয় হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, নারীকে কেউ যাতে অসম্মান না করে, তাই অভিযোগ আমলে নিয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানান আইভি। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক পরিচয়ে এসব অপরাধীকে ছেড়ে না দেয়ার দাবি করেন তিনি। নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র বলেন, নারী নির্যাতন আইনের বাস্তবায়ন না হলে নগরী কখনও নারীর জন্য নিরাপদ হবে না। নগরপিতা বা মাতা হিসেবে আমি নিজেও অনেক সময় অসহায় বোধ করি। কারণ আমার হাতে পুলিশ নেই, ম্যাজিস্ট্রেট নেই, প্রশাসন নেই। সরকার যদি মনে করে নারী নির্যাতন রোধ করবে, এটা সম্ভব। শেখ হাসিনা সরকার অতীতেও নারীর ক্ষমতায়নে অনেক করেছে। এখনও করে যাচ্ছে। আমাদের প্রত্যাশা আরও বেশি। এসব সামাজিক ব্যাধি দূর করতে বড় বড় শহরে সিটি গর্বনেন্স দেয়া উচিত। স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করতে হবে। বাড়াতে হবে তাদের আইনী ক্ষমতাও। নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা তৈরি করতে ব্যাপক প্রচারণার দরকার। এর সঙ্গে সরকারের নিতে হবে জিরো টলারেন্স নীতি। যুক্তরাজ্যের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিষয়ক সংসদীয়মন্ত্রী লিন ফেদারস্টোন এমপি বলেন, বিশ্বে প্রতি তিনজনের মধ্যে একজন কোন না কোনভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। নারী নির্যাতনের কারণে দারিদ্র্য কমছে না। সরকারকে এই সমস্যা সমাধানে কাজ করতে হবে। একই সঙ্গে তরুণ সমাজকেও এগিয়ে আসতে হবে নির্যাতন প্রতিরোধে। এ্যাকশন এইডের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্ কবির বলেন, গবেষণায় নারীর অনিরাপত্তার ভয়ঙ্কর চিত্র উঠে এসেছে। নারী নগরে যে নিরাপদ নয়, তা এই গবেষণায় স্পষ্ট। নারীকে একটি নিরাপদ নগরী দিতে সরকারকেই মূল ভূমিকা পালন করতে হবে। তিনি বলেন, নারী হিসেবে শহরে নিজেকে যদি নিরাপদ মনে না করে, তবে অন্যান্য অধিকার কিভাবে প্রতিষ্ঠা করবে। এ্যাকশন এইড বাংলাদেশ’র গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, নগরের ৪৭ দশমিক ৫ শতাংশ নারী গণপরিবহন, রাস্তা কিংবা উন্মুক্ত জনবহুল এলাকায় চলাফেরা করার ক্ষেত্রে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। গবেষণায় অংশ নেয়া ৮১ শতাংশ মানুষ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যের কাছে সহায়তার জন্য যেতে চান না। গবেষণায় অংশ নেয়া নারীর ৮৮ ভাগই বলেন, তারা পথচারী, পুরুষযাত্রী এবং ক্রেতার দ্বারা হয়রানির শিকার হন। শহরের ৯৭ শতাংশ নারী যৌন হয়রানিকে সহিংসতা মনে করেন। তারা মনে করেন, পুলিশের সাহায্য চাইলে সমস্যা বাড়ে। যৌন সহিংসতা এড়াতে ৬৪ ভাগ নারী রাতে ঘরের বাইরে যান না। নিরাপত্তাহীনতার কারণে ৬০ ভাগ নারী রাতে ঘরের বাইরে বের হওয়ার ক্ষেত্রে দলগতভাবে যেতে চান। প্রতিবেদনে বলা হয়, মানুষ চলাচলের জায়গায় ৮৫ শতাংশ নারী মর্যাদাহানিকর উক্তির শিকার হয়েছেন, ৪৬ শতাংশ নারী যৌনতাপূর্ণ অশ্লীল কথা শুনেছেন। এছাড়া রাস্তায় নারীরা যৌন হয়রানির শিকার বেশি হন বলে জানান ৮৫ শতাংশ নারী ও ৭৭ শতাংশ পুরুষ। ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেট ও নারায়ণগঞ্জ শহরের মোট ১২০০ নারী-পুরুষের ওপর গবেষণাটি পরিচালিত হয়। এর মধ্যে ৮০০ নারী ও কিশোরী এবং ৪০০ পুরুষ; যাদের বয়স ১৫ থেকে ৫৯ বছরের মধ্যে । গবেষণার মূল উদ্দেশ্য ছিল রাস্তা, বাজার, পার্কসহ নগরীর সকল জনসংযোগস্থানে নারীর ওপর যৌন নির্যাতন নিয়ে মানুষের ধারণা তুলে আনা এবং নারীর প্রতি যৌন সহিংসতামুক্ত নগর নিশ্চিত করতে নগরে সরকারী সেবার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি অনুধাবন করা। অনুষ্ঠানে ‘নিরাপদ নগরী, নির্ভয়ে নারী’ বিষয়ে গবেষণার ফল তুলে ধরেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সিনিয়র রিসার্স ফেলো ড. এম এ মান্নান। এ্যাকশন এইডের ৩০ বছরপূর্তি উপলক্ষে নারীর জন্য নিরাপদ নগরী প্রচারাভিযান শুরু হয়। নারীর প্রতি যৌন হয়রানি ও সহিংসতা কমাতে আগামী তিন বছর এই ক্যাম্পেন পরিচালনা করবে এ্যাকশন এইড বাংলাদেশ। যুক্তরাজ্যভিত্তিক রাষ্ট্রীয় দাতা সংস্থা ইউকে এইডের আর্থিক সহযোগিতা এবং বাংলাদেশের অন্যান্য উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান নিয়ে গঠিত জোট নিয়ে পরিচালিত হবে এই ক্যাম্পেন।
×