ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

রাজনীতিকসহ সমাজের গণ্যমান্যরাও সাইবার অপরাধী চক্রের ফাঁদে

প্রকাশিত: ০৪:৫২, ২৯ অক্টোবর ২০১৪

রাজনীতিকসহ সমাজের গণ্যমান্যরাও সাইবার অপরাধী চক্রের ফাঁদে

ফেসবুক এ্যাকাউন্ট ট্র্যাক করে অশ্লীল ছবি, ভিডিও ফিরোজ মান্না ॥ সাইবার অপরাধী চক্রের কবলে পড়ে বিপন্ন হচ্ছে তরুণ-তরুণীসহ সমাজের সম্মানিত ব্যক্তিবর্গের জীবন। সাইবারক্রাইম এখন শিল্প সাহিত্য অঙ্গনেও ছড়িয়ে পড়েছে। সামাজিক যোগাযোগের অন্যতম সাইট ফেসবুকের এ্যাকাউন্ট ট্র্যাকিং করছে সংঘবদ্ধ সাইবার অপরাধী চক্র। পরে ওইসব এ্যাকাউন্টে অশ্লীল ছবি ও ভিডিও ছেড়ে দেয়া হয়। এই কাজটি যে শুধু তরুণ-তরুণীদের জীবনেই ঘটছে তা নয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, ব্যবসায়ী, চলচ্চিত্র ও নাটকের অভিনেতা অভিনেত্রীদেরও একই ফাঁদে ফেলা হচ্ছে। সাইবার অপরাধীরা ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করে অভিনব কৌশলে তাদের ব্ল্যাকমেইল করছে। নিজের অজান্তে তারা এই ধরনের ফাঁদে পা দিচ্ছেন। সংঘবদ্ধ সাইবার অপরাধী চক্রের এই ধরনের নৈতিক কর্মকা-ের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের সমাজে স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাইবার অপরাধ চক্রের শিকার এমনই একজন একটি রাজনৈতিক দলের নেতা। তার ফেসবুক আইডি হ্যাক করে সেখানে একটি অশ্লীল ভিডিও স্থাপন করা হয়েছে। এতে তার সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে নেমে এসেছে চরম হতাশা। এখন সাইবার অপরাধী চক্র বিভিন্ন সময় তার কাছে বেনামী এসএমএস পাঠিয়ে বিরাট অঙ্কের টাকা দাবি করে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতির শিকার হয়ে তিনি সীমাহীন মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। বিষয়টি নিয়ে তিনি বিটিআরসির কাছে সাহায্য চেয়েও কোন ফল পাননি। বিটিআরসি বলে দিয়েছে, এটা সম্পূর্ণ ফেসবুক কর্তৃপক্ষের বিষয়। তারাই পারে ওই ভিডিও ক্লিপ তুলে নিতে। এরপর বিষয়টি নিয়ে তিনি ফেসবুক কর্তৃপক্ষের কাছে কয়েক দফা চিঠি পাঠিয়েছেন। কিন্তু তাতেও আইডি থেকে ভিডিও ক্লিপটি সরিয়ে দেয়নি ফেসবুক কর্তৃপক্ষ। তাঁর জীবন বিপন্ন হয়ে উঠেছে। সূত্র জানিয়েছে, ফেসবুক আইডি দিয়ে প্রতারিত করা হচ্ছে তরুণ-তরুণীসহ সমাজের নামি দামি মানুষদের। এই জন্য তারা বিভিন্ন স্থানে শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে। ভুয়া আইডিও খোলা হয়েছে। ওই সাইটে দেখা যায়, দেশের বিভিন্ন জেলা এবং বিভিন্ন প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে রয়েছে তাদের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক। বেনামে ভুয়া আইডিতে সাইবার অপরাধীরা সংগঠিত। দেয়া রয়েছে অশ্লীল ভাষায় কিছু পোস্ট ও ছবি। আন্তর্জাতিক অপরাধ চক্রের নম্বর থেকে কল দেয়ার কারণে এটা স্পষ্ট চক্রটির সঙ্গে বিদেশি সাইবার অপরাধী চক্রেরও যোগাযোগ রয়েছে। তাদের বিভিন্ন সফটওয়্যার আছে। এই সফটওয়্যার ব্যবহার করে তারা মানুষকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলছে। পুলিশ জানিয়েছে, সাইবার অপরাধ চক্রগুলোকে শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে। বর্তমানে সাইবার অপরাধ প্রবণতা চরম আকার ধারণ করেছে। অশ্লীল ছবি ও ভিডিও পোষ্ট করে মানুষকে ব্ল্যাকমেল করা হচ্ছে। তরুণ-তরুণীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা ও ব্যবসায়ীসহ সমাজের সব স্তরের মানুষ এই অপরাধের শিকার হচ্ছেন। সম্প্রতি ঢাকায় ও ঢাকার বাইরে এমন কয়েকটি চক্রকে ডিবি পুলিশ আটক করেছে। তাদের বিরুদ্ধে তথ্য প্রযুক্তি আইনে মামলা দায়ের করা হয়েছে। এই আইনে যারা অশ্লীল ছবি বা ভিডিও ধারণ সংরক্ষণ, প্রচার করে তাদের সর্বনিম্ন ৭ বছর থেকে সর্বোচ্চ ১৪ বছরের কারাদ-ের বিধান রয়েছে। ধরা পড়া একটি চক্র পুলিশ রিমান্ডে একাধিক অপরাধের কথা স্বীকার করেছে। এসব অশ্লীল ছবি ও ভিডিও ফেসবুক ও পর্নো ওয়েবসাইটে লাইক-শেয়ার করেছে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়ার বিধান করা হতে পারে। কারণ তারা এসব ভিডিও-ছবিতে লাইক-শেয়ার ও কমেন্টস করে সাইবার অপরাধীদের উৎসাহ দিচ্ছে। সাইবার অপরাধ ভাইরাস আকারে ছড়িয়ে পড়ায় পুলিশ এখন নড়েচড়ে বসেছে। এই অপরাধ দমনে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে পুলিশ। কোন সাইবার অপরাধীকে ছাড় দেয়া হবে না বলে পুলিশের উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে। সাইবার অপরাধীদের ধরতে পুলিশ চারদিকে প্রযুক্তির জাল বিস্তার করেছে। এখন সাইবার অপরাধীদের ধরতে আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি সমৃদ্ধ বিশেষ গাড়ি আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পুলিশ। সাইবার অপরাধীরা টার্গেট করে বিভিন্ন মানুষের এ্যাকাউন্ট হ্যাক করে জীবন বৃত্তান্তসহ অনেক ব্যক্তিগত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য চুরি করে নেয়। ওই চক্রটি সংশ্লিষ্ট ই-মেল নিয়মিত ফলো করতে থাকে। জি-মেইলে একটি ভিওআইপি সার্ভিস প্রোভাইডার ওয়েবসাইট থেকে লোভনীয় ম্যাসেজ দেয়া হয়। এতে সাড়া দিয়ে অনেকেই অপরাধীদের পাতা ফাঁদে পা দেন। কিন্তু তা না পেয়ে সরাসরি যোগাযোগের চেষ্টা করে। নিজের কৌতূহল সামলাতে পারে না অনেকেই। ওখানে কি হয় তা দেখার চেষ্টা করে। এই কৌতূহলই কাল হয়ে দাঁড়ায়-ঢুকে যান ভয়ঙ্কর জগতে। সাইবার অপরাধী চক্রের সঙ্গে জড়িতদের কর্মকা- দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিয়েছে। মোবাইল ক্যামেরায় গোপনে ধারণ করা তরুণীদের যৌনতার ছবি তারা বড় অঙ্কের টাকায় কিনে নেয়। এরপর শুরু করে তাদের খেলা। অশ্লীল ছবি বা ভিডিওটি নিয়ে চলে নানা প্রতারণা। ভুক্তভোগী তরুণীর অভিভাবকের কাছে পাঠানো হয় এসএমএস। বলা হয়, ‘আপনার মেয়ে বা বোনের একটি অশ্লীল ভিডিও আমাদের হাতে রয়েছে। ভিডিওটি ইন্টারনেটে ছেড়ে দেয়া হবে।’ তারা বিরাট অঙ্কের টাকার একটি হিসাব ধরিয়ে দেয়। এই টাকা না দিলে ভিডিওটি ইন্টারনেটে ছেড়ে দেয়া হবে। আবার এই অপরাধীরা বিভিন্ন সম্মানিত ব্যক্তি বর্গের ই-মেল আইডি ও ফেসবুক আইডিতে অশ্লীল ভিডিও ছবি জুড়ে দিয়ে তাদেরও ব্ল্যাকমেল করে যাচ্ছে। সাইবার অপরাধীদের কারণে সমাজে অনেক আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে। আবার কেউ কেউ নষ্ট জীবনের দিকে চলে যাচ্ছে। সমাজের বিভিন্ন স্তরে এই সাইবার অপরাধের ঘটনা ঘটছে। তথ্য প্রযুক্তিবিদরা বলেন, তথ্য প্রযুক্তি মানুষের জীবনকে যেমন গতি এনে দিয়েছে তেমনি অপরাধ প্রবণতাও বাড়িয়ে তুলেছে। তথ্য প্রযুক্তির সুফল কুফল দু’টোই রয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে কে কিভাবে এটা ব্যবহার করবে। প্রযুক্তি মানুষকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। যারা প্রযুক্তির মাধ্যমে অপরাধ করে তারাও কিন্তু সমাজের অগ্রগামী মানুষ। এই মানুষটাই কিন্তু ভাল পথে কাজ করলে অনেক বেশি অবদান রাখতে পারবেন। তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি হলে অপরাধ প্রবণতা কমে যাবে। পুলিশ জানিয়েছে, সাইবার ক্রাইম এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের প্রয়োগ করা অনেক সময় তাদের জন্য কঠিন হয়ে যায়। কারণ সাইবার অপরাধের শিকার ব্যক্তিরা অভিযোগ না করায় প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নেয়া যায় না। ফেসবুকে বা অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভুয়া আইডি ও গ্রুপ আইডি খুলে প্রচার চালানো হয়। এটা আসলে সাইবার অপরাধীদের প্রতারণার ফাঁদ। এই ফাঁদেই পা দিচ্ছে অনেকে। ব্যক্তিগত আক্রমণ-আপত্তিকর ছবি ও ভিডিও শেয়ারের মাত্রা বহুগুণে বেড়ে গেছে। এই অবস্থা মোকাবেলা করতে পুলিশ বিভাগের আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির প্রশিক্ষণ দরকার। কারণ প্রযুক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে প্রযুক্তি দিয়েই করতে হবে।
×