ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

একদিকে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা অন্যদিকে খালেদাপ্রেমী ধর্মান্ধগোষ্ঠী

প্রকাশিত: ০৬:১৩, ২৭ অক্টোবর ২০১৪

একদিকে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা অন্যদিকে খালেদাপ্রেমী ধর্মান্ধগোষ্ঠী

মমতাজ লতিফ প্রথমেই বলতে চাইÑ উচ্চশিক্ষিতরা যখন অন্যায় করেন কিংবা যে কোন ধরনের দুর্নীতি করেন, তখন তাঁরা নীরবে স্বেচ্ছায় পদ থেকে সরে যাবেন; এটা সবাই আশা করে এবং তা সম্মানজনক। দয়া করে অযথা বিতর্ক করে নিজেদের, সেই সঙ্গে আমাদের মতো লাখ লাখ মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধপন্থীদের মানসম্মান বিনষ্ট করবেন না। ব্যক্তিগতভাবে আমি এবং আমার মতো অনেকেই আছেন যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের আগে সংঘটিত ছাত্র রাজনীতিতে জড়িত থেকেও পারিবারিক ও অন্য কারণে জাতির মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার গৌরব অর্জন করতে পারিনি। যদিও এই যুদ্ধের নৈতিক সমর্থন দিয়েছি। এক সময় মহিলা পরিষদ থেকে বেশ কয়েকবার মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় গ্রহণের ফরম পূরণ করার জন্য অনুরোধ ও ফরম পেয়েছি। কিন্তু আমি সশরীরে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে না পারার জন্য লজ্জিতভাবে ওই অনুরোধ ও ফরম পূরণে অপারগতা জানিয়েছি। এরপর আমি স্বেচ্ছায় নিজস্ব লেখালেখি, গবেষণা কাজ করার জন্য পঁচিশ বছর সরকারী চাকরি সম্পন্ন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অবসর গ্রহণ করেছি। অবসর নেয়ার সময় মনে মনে এ চিন্তাও করেছিলাম যে, একজন তরুণ-তরুণীর জন্য একটি পদ আমি ছেড়ে দিলাম। বলাবাহুল্য, সবাই যে আমার মতো করে চিন্তা করবে, সিদ্ধান্ত নেবে, তা ভাবার কোন কারণ নেই। তবে আজ যখন উচ্চশিক্ষিত এবং সমাজে সবরকম সুযোগ-সুবিধা যারা পেশাগত কারণে লাভ করেছে, তারা কি কারণে অবসরের বয়স আরও দু’বছর বাড়ানোর জন্য ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার তকমা লাগিয়ে বড় মাপের দুর্নীতির আশ্রয় নেয়ার লোভ সংবরণ করতে পারল না এ কথা ভেবে শঙ্কিত বোধ না করে পারি না। প্রথমত : আশ্চর্য এই যে, এই ব্যক্তিরা পরিবার ও সমাজে মানসম্মান খোয়ানোর কেয়ার করে না বা গুরুত্ব দেয় না, যা পারিবারিক এবং সামাজিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়ের ইঙ্গিত বহন করে। এ ঘটনা আবারও এটাই প্রমাণ করে যে, সমাজের পচন ধরে মাথা থেকেই! মিথ্যা মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট নেয়া এসএসসি এবং এইচএসসি ইত্যাদি পরীক্ষার জাল সার্টিফিকেট ব্যবহারের চেয়ে ভয়াবহ ও কলঙ্কজনক অপরাধ। কেননা, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধারা জাতির গৌরবময় ইতিহাস এবং ইতিহাসের স্রষ্টা। তাঁরা দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান। তাঁদের নাম ব্যবহার করে ফায়দা লোটা, তাও আবার অতি উচ্চশিক্ষিত, রাষ্ট্রযন্ত্রের নিয়ন্ত্রক শক্তির সঙ্গে যুক্ত বয়স্ক ব্যক্তিদের দ্বারা যখন সংঘটিত, তখন বাঙালীর উদগ্র লোভের একটি খ-চিত্র দেখে আরেকবার অধোবদন হই। ভুলিনি, এর আগে মুক্তিযুদ্ধের বিদেশী বন্ধুদের সরকার কর্তৃক স্বীকৃতি ও শ্রদ্ধার নিদর্শনস্বরূপ সোনার মেডেল প্রদানের প্রকল্পটিকে ভূলুণ্ঠিত করার লক্ষ্যে ও অর্থের লোভে কর্মকর্তাদের চার ভাগের তিন ভাগ খাদ মিশিয়ে সোনার মেডেল তৈরি করার নির্লজ্জ পদক্ষেপের কথা! সে সময়ের মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী থেকে শুরু করে ওপরের স্তরের আমলারা ওই অপকর্মটি সাধন করে জাতির কাছ থেকে যে ঘৃণা-ধিক্কার লাভ করেছে, তা তাদের মৃত্যুঅবধি তাড়া করবে বলে বিশ্বাস করি। এ চুরি করা অর্থের সঙ্গে লেগে আছে যে ঘৃণা ও ধিক্কার তা তাদের পরিবারের মৃত্যুর পরও ছাড়বে না। এদের বিচার, জেল ও সম্পদ বাজেয়াপ্ত হয়েছে কিনা জানি না, তবে সরকারকে এত বড় অসম্মানের মুখে ফেলার জন্য এ অপরাধের অপরাধীদের যোগ্য শাস্তি দিয়ে খাদ মেশানো মেডেলের বদলে খাঁটি সোনার মেডেল ওই মৈত্রী সম্মাননা পাওয়া সম্মানিত ব্যক্তিদের কাছে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করবেন বলে আশা করি। এটি করা গেলে আমাদের কিছুটা মুখরক্ষা হয় এবং চাইলে এটি করা সম্ভব। এই দুটি ঘটনাই উচ্চ শিক্ষিতদের শঠতা- প্রতারণার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। অন্তত একটি বিষয় এ দুটো ঘটনা থেকে উন্মোচিত হয়েছে যে, ঘটনা সংঘটনকারীরা কোনভাবেই জাতির গৌরবজনক ঘটনা মুক্তিযুদ্ধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়। সুতরাং, মুক্তিযুদ্ধের পরিকল্পক, পরিচালক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দীনসহ সব নেতা এবং লাখ লাখ শহীদ ও জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শÑ চার মৌল প্রত্যয়ের প্রতি বিশ্বাসী নয়। গভীরভাবে ভেবে দেখলে দেখা যাবে এদের মনমানসিকতা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের প্রতি পুরোপুরি উদাসীন ও শ্রদ্ধাবোধহীন। এদের অধিকাংশের জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঘটেছে ’৭৬ থেকে সূচিত মুক্তিযুদ্ধবিরোধী, যুদ্ধাপরাধী এবং পাকিস্তানপন্থী জিয়া, খালেদা জিয়া, এরশাদ ও তারেকের শাসনামলে। এ তো বলাবাহুল্য, অথচ এরাই প্রশাসন যন্ত্রের পরিচালক যাদের দ্বারা মুক্তিযুদ্ধপন্থী সরকার তার সব রকমের কর্মকা- পরিচালনা এবং বাস্তবায়ন করে থাকে। সরকারের পক্ষে বিশেষত যে সরকার মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বাস্তবায়নে অঙ্গীকারাবদ্ধ এবং জাতির বড় মাপের দুটি কলঙ্ক থেকে জাতিকে মুক্তিদানে দায়িত্বপ্রাপ্ত যার একটি বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার। অপরটি, একাত্তরের মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীর বিচার। আশ্চর্য হলেও সত্যি, বঙ্গবন্ধু নিহত হলে মুক্তিযুদ্ধপন্থী সরকারকে উৎখাত করে রাষ্ট্রক্ষমতা দীর্ঘকালের জন্য যখন জিয়া, খালেদা, এরশাদ ও তারেকের কুক্ষিগত হলো তখন মুক্তিযোদ্ধাদের নিচে নামিয়ে দিয়ে একাত্তরের খুনী যুদ্ধাপরাধীরা গোলাম আযমের নেতৃত্বে সমাজে ক্ষমতাবান হয়ে উঠেছে। এদের মধ্যে কিছু ব্যক্তির ধনসম্পদ ক্ষমতা অর্জন করেও সমাজে ‘ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা’ হওয়ার এক অসম্মানজনক প্রবণতা দেখা দিল! অন্যদিকে, রাজাকার যুদ্ধাপরাধীদের জন্মদাতা জামায়াত-শিবির ক্ষমতাবান হতে লাগল, হরকত-উল-জেহাদ, হিযবুত তৌহিদ, জেএমবি, হিযবুত তাহ্রীর ইত্যাদি নামে তারা শত শত জঙ্গী মৌলবাদী দলের জন্ম দিতে লাগল। অনেক রাজাকার পর্যন্ত ‘মুক্তিযোদ্ধা’ তালিকায় নামও তুলল। এরা গাছেরও খাবে তলারও কুড়াবে! এই সময়ে যারা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছে তারা তো তাদের কাছ থেকে শিখেছে : ইসলাম ধর্ম ও পাকিস্তান ধ্বংস করতে মুক্তিযুদ্ধ করেছে শেখ মুজিব, আওয়ামী লীগ ও হিন্দু ভারত! রাজাকার নেতা গোলাম আযম ইসলাম ও ইসলামের ঘর পাকিস্তান রক্ষার জন্য পাকিস্তানকে সহযোগিতা করেছে তাদের দালাল হয়ে। বাংলাদেশকে ’৭৬ থেকে ‘মিনি পাকিস্তান’ করতে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বাদ দেয়া হলো, উপরন্তু সংবিধানের মাথায় বসানো হলো ‘বিসমিল্লাহ্’ এবং তখন থেকে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান, আদিবাসীকে করা হলো দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক। দরিদ্র, অনুন্নত দেশে সামরিক প্রেসিডেন্ট জিয়া ঘোষণা করলÑ ‘মানি ইজ নো প্রবলেম’। ব্যস ‘মানি’ লুটপাট, সম্পদ দখল, দুর্নীতি রাষ্ট্রীয় নিয়মে পরিণত হলো! যে যেভাবে পারে, ধনী ও ‘মানিড্ ম্যান’-এ পরিণত হওয়ার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ল! গণতন্ত্রের জন্য দীর্ঘকাল লড়াই করা বাঙালীকে সামরিক শাসক জিয়া হুমকি দিলেন, ‘আই উইল মেক পলিটিক্স ডিফিকাল্ট ফর পলিটিশিয়ানস!’ ব্যস, তৈরি হলো মাস্লম্যান, কালোটাকা দিয়ে ক্যাডার, যাদের কাজ হলো ভোট ছিনতাই, ভোটারদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া, বাড়ি থেকে বের হতে না দেয়া, ভোটকেন্দ্র দখল, ব্যালটবাক্স দখল, রাজনৈতিক নেতাকর্মী খুন, রাজনৈতিক সভা-সমাবেশে গুলি চালিয়ে, মারপিট করে সভামঞ্চ ভেঙ্গে সমাবেশ প- করা! অন্যদিকে রাষ্ট্রযন্ত্র রাজনীতিকদের নানা মামলা দিয়ে, জেল-জুলুম দ্বারা শায়েস্তা করতে লাগল! স্বভাবতই এই অস্বাভাবিক পরিবেশে যারা কৈশোর ও তারুণ্য পার করেছে, তারা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ এবং প্রেরণা, এর জন্য আত্মত্যাগী রাজনৈতিক নেতৃত্বের ওপর নির্যাতন ইত্যাদি সম্পর্কে অন্ধকারে থেকে পেশি-অস্ত্রভিত্তিক অপরাজনীতিকে ‘রাজনীতি’ গণ্য করেছে! এ রাজনীতি মানে জবরদখল, খুন-খারাবি-দুর্নীতি, কালোটাকা আয়, অস্ত্র-পেশি ব্যবহার এবং সর্বোপরি ‘মিথ্যাকে’ ‘সত্য’ হিসেবে উপস্থাপন করাকে কোন অপরাধ বলে বিবেচনা করার শিক্ষাটিও লাভ করেনি! এদেরই বড় একটি অংশ বর্তমানে প্রশাসনে, নিরাপত্তা বাহিনীতে, বিচার বিভাগে, শিক্ষায়, ব্যবসায়সহ সমাজের সবক্ষেত্রে দৃঢ় অবস্থানে আছে। এরা নিজেদের আত্মসম্মান, আত্মমর্যাদা, পরিবারের স্ত্রী-সন্তানদের মানসম্মানকে অর্থের কাছে জলাঞ্জলি দিতে এক মুহূর্তও দ্বিধা করবে নাÑ এটাই স্বাভাবিক। এদেরই বর্তমানে নানা রকম সম্মানহানিকর অবস্থানে জাতি দেখতে পাচ্ছে। জাতিকে এই কয়েকটি জেনারেশনের অবসান পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবেÑ সেই তরুণ প্রজন্মের অপেক্ষায় যারা শাহবাগে ২০১৩ সালে জাতিকে পাকিপন্থী শাসকদের তৈরি ধুলোর আড়ালে বিস্মৃত ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি ফিরিয়ে এনে দিয়েছিল! তাদের উত্থানের সময় পর্যন্ত! এই দেশপ্রেমিক তরুণ প্রজন্মই দুর্নীতি-অর্থলোভ, অস্ত্র-পেশিভিত্তিক রাজনীতি-সমাজনীতি-শাসননীতিকে এসব দুরাচার-দুর্নীতি এবং লোভ থেকে মুক্ত করবে এবং প্রতিষ্ঠিত করবে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত আদর্শভিত্তিক প্রশাসন ব্যবস্থা ও রাজনীতি। স্মরণ রাখতে হবে- দুর্নীতিবাজদের মুখে ‘চোরের মায়ের বড় গলা’ শুনতে চায় না জাতি। তাঁরা নীরবে অপরাধ স্বীকার করে সরে যাবেন, অযথা মানসম্মান প্রশ্নে মামলা বা অন্য বিতর্ক না করে নিজেদের, স্বজনদের এবং আমাদের আর অবমাননা করবেন না এটাই কাম্য। এদিকে আবার দেখা যাচ্ছে, খালেদা-তারেকপন্থী উগ্র ধর্মানুগোষ্ঠীর দল লতিফ সিদ্দিকীর গ্রেফতারের দাবিতে, কেউ কেউ বলছেন, আসলে খালেদার কোর্টে হাজিরা থেকে অব্যাহতি দিতেই, তারা হরতাল আহ্বান করেছে! এদের প্রশ্ন করি খুনী-জঙ্গী, নারীধর্ষক ও বালক-ধর্ষকদের গ্রেফতার করার দাবি করবেন কি? নাকি, এসব বিশাল অপরাধ আপনাদের কাছে অপরাধ বিবেচিত হয় না? আরেকটি প্রশ্নÑকোরআনে আল্লাহ্ বলেছেন, সীমালঙ্ঘনকারীকে তিনিই দ- দেবেন, কোন মানুষ এ বিচার করার দায়িত্ব লাভ করেনি। তাহলে, আপনারা কেন কোরআনের ওই নির্দেশনা ভঙ্গ করছেন? এজন্য আপনাদের শাস্তি কে দেবে? দেশের মানুষ এখন সব বোঝে। তাদের নিয়ে রাজনীতি করতে হলে কোন লুকোচুরি খেলা খেললে ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তাই সময় থাকতে সাবধান হয়ে যান। কেন হরতাল ডাকা হলো? জনমনে প্রশ্ন উঠেছেÑ এ নিয়ে সন্দেহও তৈরি হয়েছে। তারা বলছেন, খালেদা-তারেকের ওপর ভরসা করে তাঁদের তুষ্ট করতে আপনারা হরতালের মতো ইহলৌকিক পদক্ষেপ গ্রহণ করলেন? আপনারা আসলে কোন্টিতে বিশ্বাস করেন? মানি ইজ নো প্রবলেম? নাকি মানি ইজ দ্য প্রবলেম। আপনারা কি ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের শাস্তি দাবি করেন? আপনারা কি খাদ মেশানো মেডেল তৈরিকারী জোচ্চোর আমলাদের শাস্তি দাবি করেন? আপনারা কি জঙ্গী, নারী ও বালক ধর্ষকদের মুরতাদ ঘোষণা করবেন? তারা তো শামসুর রাহমান বা তসলিমার চাইতে অনেক বেশি অপরাধী। তাই নয় কি? শুধু খালেদা-তারেকের পুতুল নাচের পুতুল হয়ে থাকবেন না আশা করি।
×