ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আমি হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল...

প্রকাশিত: ০৬:১০, ২৭ অক্টোবর ২০১৪

আমি হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল...

সমুদ্র হক হাতের মুঠোয় সেল ফোনে গোটা বিশ্ব এগিয়ে চলেছে। বাঙালীও এই কালচার থেকে পিছিয়ে নেই। মোবাইল সংস্কৃতিতে বাঙালীর অগ্রযাত্রা অব্যাহত রয়েছে। একবিংশ শতকে বিশ্বায়নের এই যুগে ঠুনকো যুক্তি দিয়ে সংস্কৃতির ধারার সামাজিক কর্মকা- রুদ্ধ করে দিতে চাইলে পার পাওয়া যাবে না। নদী যেমন আপন বেগে ছুটে সাগরে গিয়ে মিশে, সংস্কৃতির সামাজিক স্রোতও নদীর মতোই বয়ে চলে। বাঁধ দিয়ে নদীর গতি হয়তো সাময়িক ঠেকানো যায় সাগরের টান থেকে ফেরানো যায় না, যে ভাবেই হোক পথ খুঁজে নেয়। সামাজিক কর্মকা-ে জন্মদিন (বার্থ ডে), বিয়ে বার্ষিকী (ওয়েডিং ডে), মধুচন্দ্রিমা (হানিমুন) আপন গতিতেই প্রবেশ করেছে অনেক আগে। সামাজিক এই আচার বা কালচার বর্তমানে আর শহুরে জীবনের বৃত্তের মধ্যে নেই। বৃত্তের বাইরে মাঠপর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে। হালে আরও কয়েকটি শব্দ যোগ হয়েছে ডেটিং, এক্সট্রা মেরিটাল রিলেশন্স, লিভ টুগেদার, বয় ফ্রেন্ড-গার্ল ফ্রেন্ড (ডিপেন্ড অন জেন্ডার) সংস্কৃতির এই সামাজিক অধ্যায় বিশ্বায়নের যুগের দাবিতে নগর মহানগর ছাড়িয়ে মাঠপর্যায়ে বিস্তৃতি পাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, টুইটার এসব অধ্যায় দ্রুত ছড়িয়ে দিচ্ছে। বর্তমানে ল্যাপটপ নোট বুক নেট বুক কম্পিউটারও রিপ্লেস হচ্ছে এ্যানরয়েড আইপড, ইপড সেল ফোন, বিশেষ ধরনের ট্যাব কম্পিউটার দিয়ে। প্রযুক্তির নিত্যনতুন আপডেটে এত দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে যে তা ঠাহর করাই কঠিন। ক’দিন আগের মডেলও পুরনো হচ্ছে দ্রুত। সামাজিক জীবনে এখন আর পারিবারিক বন্ধনে সেই ফাউন্টেন পেনে সাদা কাগজে লিখা চিঠি হলুদ খামে ভরে পোস্ট অফিসে বাক্সে ফেলতে হয় না। আজকের তরুণ পোস্টকার্ড চেনে না। খাকি রঙের কার্ডে চিঠি লিখে যে ডাক বাক্সে ফেলা হতো তা শুনে তারা হাসে। একটা সময় নীল প্যাডে চিঠি লিখে নীল খামে ভরে ডাক বাক্সে ফেলার পর দিন কাটত অধীর আগ্রহে কখন ফেরত চিঠি আসবে! এই চিঠি ছিল প্রণয়ের মধুময়তার চিঠি। সেই দিনগুলো এখন নিকট অতীত। বর্তমানের তরুণরা পোস্ট বলতে বোঝে ফেসবুকে কোন কিছু পোস্ট করা। চিঠির বদলে সেল ফোনের ছোট্ট টেক্সট মেসেজ। হাতের মুঠোর আইপড ইপড কম্পিউটার খুলে ফেসবুকে ফ্রেন্ডের (বন্ধু) কাছে স্টেটাস দেয়া। ফেসবুকে হোয়াটস অন ইউর মাইন্ডের ঘরে মনের কথা খুলে বলা। সেই কবে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখে গেছেন ‘আমি হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল,...অনেক কথা যাও যে বলি কোন কথা না বলি তোমার ভাষার বোঝার আশা দিয়েছি জলাঞ্জলি’ এ ধরনের অনেক গান। সেদিনের প্রেক্ষাপটে ছিল এ রকম- মানব-মানবী কখনও গোপন, অভিসারে কখনও কাছাকাছি বসে ওই কথাগুলো বলার জন্য কতই না আকুলি-বিকুলি...। আজকের দিনে প্রযুক্তির আধুনিকায়নের প্রেক্ষাপটে সেল ফোনে বা ফেসবুকে একই ধরনের আকুলি-বিকুলি। ডেটিং শব্দটির আভিধানিক বাংলা প্রতিশব্দ খুঁজে পাওয়া যায় না। বলা হয় ডেটিং বিষয়টি এসেছে ইউরোপ থেকে। ডেটিং শব্দটিকেই জগাখিচুড়ি করা হয়েছে। সাদামাটায় ডেটিং বলতে যা বোঝানো হয় তা হলো- কোন একটি নির্দিষ্ট তারিখে (বা সময়ে) নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে প্রণয়ের মানব-মানবী এক সঙ্গে বসে কথা বলা। ডেটিংয়ের এই ধারায় নতুন প্রেমিক-প্রেমিকাও হতে পারে আবার এক্সট্রা মেরিটাল রিলেশন্সের মানব-মানবী হতে পারে। অর্থাৎ বিয়ের আগে ও বিয়ের পরে প্রণয়ের ডেটিংয়ে জীবনের ভাললাগার, ভালবাসার কথাগুলোই ঘুরে ফিরে, বার বার উঠে আসে। ফ্রয়েডের ভাষায় মানুষের বায়োলজি ও রসায়ন সেই আদিকাল থেকেই বহু বর্ণে বিচিত্র। মানব-মানবীর মধ্যে বায়োলজি ও রসায়ন বিয়ের আগে ও বিয়ের পরে শান্ত ও সুপ্ত দুই অবস্থাতেই থাকে। এই রসায়ন থেকেই তৈরি হয় হৃদয়ের আকুল আকুতির চাওয়া-পাওয়া। ভারতীয় পুরনো বাংলা দীপ জ্বেলে যাই ছবির গল্পটি ছিল মানব জীবনের সূক্ষ্ম মনোস্তত্ত্ব নিয়ে। ছবিতে ন্যাশনাল সাইকো এ্যানলিটিক্যাল ক্লিনিকের ডাক্তারের চরিত্রে রূপদানকারী অভিনেতা পাহাড়ী স্যানাল নার্স রাধার চরিত্রে অভিনয়কারী সুচিত্রা সেনকে মানব শিশু ভূমিষ্ঠের পর কিভাবে বেড়ে ওঠে একটা পর্যায়ে রোমান্টিকতার ধারায় পৌঁছে যায় তার সুন্দর বর্র্ণনা দেন। রোগীকে সুস্থ করতে কি করা দরকার তা বলার পর নার্স রাধা প্রণয়ের অভিনয়ে অনেক রোগীকে সেরে তোলার পর নিজেই এক সময় প্রণয়ের রোগে আক্রান্ত হলে যে সেলে রোগীরা থাকত সেই সেলেই ঠাঁই হয়। ডেটিং এক্সট্রা মেরিটাল রিলেশন্স পৃথিবীর আদিকাল থেকেই ছিল এবং কালের পরিক্রমায় তা এখনও বহাল আছে। তবে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এর ধরন পাল্টেছে। লিভ টুগেদার কনসেপ্ট নতুন নয়। আগে যা ছিল নীরবে নিভৃতে গোপনে এখন তা যেন অনেকটাই ওপেন হয়ে গেছে। বর্তমানে নানা কারণে ডেটিং বিষয়টিকে বিতর্কিত করে তোলা হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশ এবং তার অপব্যবহার ডেটিংকে কলুষিত করে তুলছে। আজকাল প্রায়ই দেখা যায় প্রেমিক-প্রেমিকার একান্ত সান্নিধ্যের দৃশ্য ছড়িয়ে পড়ছে ইন্টারনেটেÑ তবে এর পেছনে অসৎ উদ্দেশ্য থাকে অথচ মানব-মানবীর হৃদয়ের অনেক কথা বলা, একের ভাবনা সৃষ্টিশীলতা প্রিয় মানুষের মধ্যে খুঁজে পেয়ে তার সঙ্গে বসে শেয়ার করে আরও নতুন কিছু সৃষ্টি করা, কোন কারণে দুঃখবোধ ও অস্থিরতা পেলে প্রিয় মানুষের সঙ্গে বসে শেয়ার করে অস্থিরতা দূর করতে ডেটিং যে মানব-মানবীর মনোজগতকে সুন্দর করে রাখার কত বড় মাধ্যম তা বিশ্বজুড়ে সমাদৃত। উন্নত বিশ্বে একাকীত্ব জীবন থেকে কিছুটা সময়ের জন্য স্বস্তি পেতে নারী-পুরুষ উইক এন্ডে লং ড্রাইভে চলে যায়। বিদেশ বিভূঁইয়ে কোন বাঙালী সাপ্তাহিক ছুটির দিনে ৮০-৯০ মাইল দূরে বন্ধু বা বান্ধবীর সঙ্গে কথা বলে সময় কাটাতে ডেটিংয়ে বেরিয়ে পড়ে। আমাদের দেশেও প্রণয়ের মানুষ একে অপরকে চিনতে অথবা কোন দম্পতির কোন একজন নিজের অস্তিত্ব ক্রিয়েটিভিটি অন্য কারও মধ্যে খুঁজে পেলে তার সঙ্গে কিছুটা সময় শেয়ার করে। তার অর্থ এই নয় যে, সংসারের বাঁধন ছুটে গেল। এক ঘেয়ে জীবন থেকে কিছুটা সময় বের করে দু’জন মানুষ নিজের কথা শেয়ার করে নীড়ে ফিরে আসা। জীবনে বেঁচে থাকতে এই সুন্দর বেসিক নেসেসিটির রোমান্টিকতাকে আমরা ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে দিন দিন এর নেতিবাচক দিকটি তুলে ধরছি। যার সুদূরপ্রসারী প্রভাব আমাদের সমাজে পড়ছে যার প্রতিফলন সাম্প্রতিককালে দেখা যাচ্ছে বলে মনে করেন সমাজবিজ্ঞানীরা। বর্তমানে কি শহর কি গ্রাম সব জায়গাতেই আধুনিকতার ছাপ পড়েছে। একটা সময়ে গাঁয়ের বধূ অবগুণ্ঠনে বসে থাকত। গ্রামের মেয়ে একা একা স্কুল-কলেজে যেতে ভয় পেত। আজ সেই গাঁয়ের বধূ মোবাইল ফোনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলে। মেয়েরা জিনস টি-শার্ট পরে স্কুল-কলেজে যায়। সমাজে এই অগ্রগতির চিত্র আমাদের যেমন আশাবাদী করে তোলে তেমনি কোন কোন অশুভ মহল অগ্রগতির এ ধারাকে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ব্যবহার করছে যা সবার জন্য উদ্বেগজনক।
×