ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

দুষ্টগ্রহের বিদায়

প্রকাশিত: ০৪:৪৮, ২৬ অক্টোবর ২০১৪

দুষ্টগ্রহের বিদায়

আবদুল মান্নান গোলাম আযম। এক নামেই তাঁকে বাংলাদেশের ষোলো কোটি মানুষ চেনেন। চল্লিশ বছর আগে তাঁকে সাড়ে সাত কোটি মানুষ চিনত, এখন দেশের ভিতরে ষোলো কোটি মানুষ তো চেনেনই, দেশের বাইরেও কোটি কোটি মানুষ এই অভিশপ্ত চরিত্রটিকে চেনেন। তাঁর এই পরিচয় কোন ভাল কাজের জন্য নয়। তাঁর এই ব্যাপক পরিচিতির কারণ তিনি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালীর বিরুদ্ধে পাকিস্তানের দখলদার সেনাবাহিনীকে শুধু সকল প্রকার মদদ দিয়েছিলেন তাই নয়, নিজের রাজনৈতিক দল পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীকে পাকিস্তানী ঘাতক সেনাবাহিনীর অবিচ্ছেদ্য অংশ করে তুলেছিলেন। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের আমির। পরবর্তীকালে হয়েছিলেন জামায়াতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির। গোলাম আযম হয়ে উঠেছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতা ও গণহত্যার একজন মূর্ত প্রতীক। একাত্তর সালে তাঁর অপরাধের জন্য বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বয়সের কথা বিবেচনা করে গোলাম আযমকে ৯০ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছিল। সেই কারাদণ্ড ভোগ করা অবস্থায় তিনি গত বৃহস্পতিবার রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে মৃত্যুবরণ করেন। বঙ্গবন্ধুকে তিনি বাংলাদেশ সৃষ্টিতে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য চরম ঘৃণা করতেন। সেই বঙ্গবন্ধুর নামের হাসপাতালেই তাঁর মৃত্যু হলো। খবরটি যখন প্রথম জানা যায় তখন আমি একটি প্রাইভেট টিভি চ্যানেলের এক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করছিলাম। সঙ্গে অনুষ্ঠানের সঞ্চালকসহ আরও চারজন আলোচক উপস্থিত ছিলেন। সংবাদটি প্রচার করে সঞ্চালক আমাদের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলেন। শুধু বললাম, সংবাদটি অনুষ্ঠানে এসেই শুনেছি, মারা গেছেন কারাগারে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধীর দণ্ড মাথায় নিয়ে, এর বেশি কিছু বলার নেই। অন্যরাও আমার কথার সঙ্গে সুর মেলালেন। গত কয়দিন গোলাম আযমের মৃত্যু সংবাদ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ তোলপাড় চলছে। তোলপাড়ের অন্যতম ইস্যু তাঁর মৃত্যু সংবাদটি কোন্ গণমাধ্যম কেমনভাবে প্রচার করেছে তা নিয়ে। কেউ কেউ তাঁদের প্রতিক্রিয়ায় লিখেছেনÑ বেশ কয়েকটি টিভি চ্যানেল গোলাম আযমের মৃত্যু সংবাদ প্রচার করে ‘ইন্নালিল্লাহ...’ পড়েছে বা কোন কোন পত্রিকা তা লিখেছে। তাঁদের মতে তা অনুচিত হয়েছে। একজন মুসলমানের মৃত্যুর পর ‘ইন্নালিল্লাহ’ পড়াটা নিয়ম। কিন্তু গোলাম আযম যেহেতু দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন আর নিরপরাধ মানুষ হত্যা করে নিজের হাতকে রক্তে রঞ্জিত করেছেন সে কারণে তিনি শাশ্বত ইসলামের মর্মবাণীর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। ইমাম আবু হুরাইরার মতে, হযরত মুহাম্মদ (দ.) বলেছেন, ‘সেই ব্যক্তিই মুসলমান যার জিহ্বা আর হাত হতে সকল মানুষ নিরাপদ থাকে।’ একাত্তরে গোলাম আযমের হাত ও তাঁর জিহ্বার কারণে বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে এমন কেউই নিরাপদ ছিলেন না। আর বড় প্রশ্ন যাঁদের হত্যাকা-ে গোলাম আযম সহায়তা করেছেন তাঁদের মৃত্যুর পর তিনি কি ‘ইন্নালিল্লাহ’ পড়েছিলেন? একমাত্র জামায়াতের মুখপত্র ‘নয়া দিগন্ত’ গোলাম আযমের মৃত্যু সংবাদটি প্রধান সংবাদ (লিড নিউজ) করে তাঁকে মহিমান্বিত করার চেষ্টা করেছে। তারা তাঁর একটি সংক্ষিপ্ত জীবনীও ছেপেছে। কিন্তু সেই জীবনীতে ১৯৭১ সালকে চতুরতার সঙ্গে গায়েব করা হয়েছে। একটি অনলাইন পত্রিকায় গোলাম আযমের কনিষ্ঠ সন্তান সালমান আযমী তাঁর পিতা সম্পর্কে ‘সন্তানের চোখে অধ্যাপক গোলাম আযম’ শিরোনামে একটি পুরনো লেখা পুনর্মুদ্রণ করেছে, যেখানে তিনি বলার চেষ্টা করেছেন তাঁর পিতা কত বড় মাপের একজন মহান ব্যক্তি ছিলেন এবং কী অন্যায়ভাবে তাঁর পিতাকে যুদ্ধাপরাধের দায়ে কারাদ- দেয়া হয়েছে। জামায়াত-বিএনপির মতো সালমানও তাঁর লেখায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। গোলাম আযম ও তাঁর দল তাঁকে ভাষাসৈনিক হিসেবে পরিচিতি দিতে পছন্দ করে। অনেকের প্রশ্ন তিনি কিভাবে এই তকমার অধিকারী হলেন? ১৯৪৮ সালে যখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী ঢাকা সফর করেন তখন ঠিক হলো বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়ে ডাকসুর পক্ষ হতে একটি স্মারকলিপি দেয়া হবে। ১৯৪৮ সালে ডাকসুর সহ-সভাপতি ছিলেন অরবিন্দ বসু আর সাধারণ সম্পাদক গোলাম আযম। স্বাধীনতার পূর্ব পর্যন্ত ডাকসুর সভাপতি আর সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হতেন পালাক্রমে, আবাসিক হলভিত্তিক। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ছাত্রছাত্রীদের সরাসরি ভোটে প্রথম সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। ১৯৪৮ সালে সাধারণ সম্পাদক ছিলেন গোলাম আযম। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের শুরু থেকে এর বিরুদ্ধে মুসলিম লীগ সরকারের একটা বড় অভিযোগ ছিল এই আন্দোলন ভারত থেকে আসা হিন্দুদের মদদে হচ্ছে। লিয়াকত আলী খানের হাতে যদি স্মারকলিপিটা অরবিন্দ বসু দেন তা হলে লীগ সরকারের এই প্রচারণা আরও জোর পাবে। ঠিক হলো সহ-সভাপতির বদলে সাধারণ সম্পাদকই স্মারকলিপিটা প্রধানমন্ত্রীর হাতে দেবেন। গোলাম আযম সেই কাজটিই করেছিলেন। সেই এক কর্মের কারণেই তিনি ভাষাসৈনিক। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি একাধিকবার বলেছেন ভাষা আন্দোলন মারাত্মক ভুল ছিল। কেউ কেউ তাঁকে আবার মওলানা ভাসানীর আদলে মজলুম জননেতা বলেও সম্বোধন করেন। কেন করেন তার কোন ব্যাখ্যা নেই। তবে সব কিছুকে ছাড়িয়ে গেছে তাঁর একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের পরিচয়। ১৯৭১ সালে পুরো মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বাংলাদেশে সকল ধরনের অপকর্মের সঙ্গে জড়িত থেকে যখন বুঝলেন তাঁর সাধের পাকিস্তান ভেঙ্গে যাচ্ছে তখন তিনি ২২ নবেম্বর পাকিস্তানে চলে যান এবং সেখানে পরবর্তীকালে গঠন করেন ‘পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটি।’ তাঁর এই সংগঠনকে তিনি মধ্যপ্রাচ্যের আরব রাষ্ট্রগুলোতে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে প্রচার চালানোর জন্য পরবর্তী কয়েক বছর ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেন। তাঁর এই কাজে তাঁকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ভুট্টো ব্যাপকভাবে সাহায্য করেন এবং মাহমুদ আলী নামক একজনকে সার্বক্ষণিকভাবে তাঁর জন্য নিয়োজিত করেন। ১৯৭৩ সালে এই কমিটির নামে গোলাম আযম লন্ডনে একটি দফতর খোলেন এবং সেখান হতে ‘সোনার বাংলা’ নামের একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেন যার একমাত্র উদ্দেশ্যই ছিল বাংলাদেশের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালানো। ১৯৭৫ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালানোর জন্য তিনি সৌদি আরব সফর করেন। এর আগে বাংলাদেশকে সৌদি আরব স্বীকৃতি না দেয়ার জন্য তিনি বাদশাহ ফায়সালকে সাতবার অনুরোধ জানান। সৌদি আরব বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর। তাঁর প্রচারণার মূল বিষয় ছিল বাংলাদেশ হিন্দুরা দখল করে নিয়েছে এবং সব মাদ্রাসা ও মসজিদকে মন্দিরে রূপান্তরিত করেছে। এগুলো পুনর্নির্মাণ করার জন্য মুক্তহস্তে দান করার জন্য তিনি সকলকে আহ্বান জানাতেন। এই কথা বলে তিনি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো হতে কত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তার কোন হদিস নেই। বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৩ সালের ১৮ এপ্রিল আরও অনেকের সঙ্গে গোলাম আযমের নাগরিকত্ব বাতিল করে। ১৯৭৮ সালের ১১ আগস্ট জিয়াউর রহমানের সরকার গোলাম আযমকে পাকিস্তানী পাসপোর্ট নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের অনুমতি দেয়। এই জিয়াউর রহমানই বঙ্গবন্ধু সরকার কর্তৃক সাংবিধানিকভাবে নিষিদ্ধ ঘোষিত জামায়াতসহ সকল ধর্ম ব্যবসায়ী দলকে স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনীতি করার অনুমতি দেন। পাকিস্তানী নাগরিক গোলাম আযমকে জামায়াত ১৯৯১ সালের ২৯ ডিসেম্বর তাদের আমির নির্বাচিত করে। তবে তিনি বাংলাদেশে ফেরার পর হতেই জামায়াতের মূল নীতি নির্ধারক ছিলেন। গোলাম আযম ও অন্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ১৯৯১ সালে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি।’ শহীদ জননীর এই আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়ে সারা বাংলাদেশে। তাঁর নেতৃত্বে আয়োজিত হয় গণআদালত, যেখানে গোলাম আযম আর তাঁর দোসরদের প্রতীকী বিচার হয় এবং তাঁদের মৃত্যুদ-ে দ-িত করা হয়। সেই সময় বেগম জিয়া ক্ষমতায়। তাঁর সরকার শহীদ জননীসহ এই গণআদালতের সঙ্গে যাঁরা জড়িত ছিলেন তাঁদের ২৪ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতা মামলা দায়ের করে এবং মামলা মাথায় নিয়ে শহীদ জননী বাংলাদেশ হতে অনেক দূরে যুক্তরাষ্ট্রে মৃত্যুবরণ করেন। জিয়াউর রহমান হোক আর বেগম জিয়া তাঁদের দু’জনের সঙ্গেই গোলাম আযম ও জামায়াতের একটি আত্মার সম্পর্ক ছিল। গোলাম আযম বা যুদ্ধাপরাধীদের অনেক সুহৃদ প্রায়শ বলে থাকেন বঙ্গবন্ধু সরকার তো যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা করে দিয়েছেন, তাহলে আবার তাঁদের বিচারের প্রশ্ন কেন আসবে? তাঁরা ভুল বলেন। বঙ্গবন্ধু ঘোষিত সাধারণ ক্ষমা সকলের বেলায় প্রযোজ্য ছিল না। সুনির্দিষ্টভাবে যাঁরা মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তাঁরা এই ক্ষমার আওতার বাইরে ছিলেন, যাঁদের শীর্ষে ছিলেন গোলাম আযম। ২০০৮ সংসদ নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনা অঙ্গীকার করেছিলেন তিনি ক্ষমতায় গেলে এই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবেন। তিনি তাঁর কথা রেখেছেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছে এবং গোলাম আযমসহ তাঁর একাধিক সাথী ঘাতকের সেই ট্রাইব্যুনালে বিচার হয়েছে। এঁদের কয়েকজনের মৃত্যুদ- ও কয়েকজনের আমৃত্যু কারাদ- হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ ও তার পরবর্তী প্রজন্ম শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারের কাছে কৃতজ্ঞ। গোলাম আযমকে আবার ‘অধ্যাপক’ গোলাম আযমও বলা হয়। তিনি ১৯৫০ হতে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত রংপুর কারমাইকেল কলেজে শিক্ষকতা করেছেন। চার বা পাঁচ বছর কলেজে শিক্ষকতা করলে কেউ ‘অধ্যাপক’ হয় না। এটি হতে হলে অনেক ধাপ পার হতে হয়, যা গোলাম আযম হননি। গোলাম আযম একাত্তরে সব সময় বলতেন ‘পাকিস্তান হচ্ছে বিশ্ব ইসলামের আবাস। সুতরাং পাকিস্তানের অখ-তা না থাকলে জামায়াতের কর্মীদের বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই।’ গোলাম আযমের পাকিস্তানের অখ-তা বাংলাদেশের ত্রিশ লাখ শহীদ আর আড়াই লাখ নির্যাতিত মা-বোন ১৯৭১ সালে ভেঙ্গে দিয়েছেন। সুতরাং গোলাম আযমের মরদেহ দাফন করার জন্য অবশিষ্ট পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেয়াটাই যুক্তিসঙ্গত ছিল। যে দেশের জন্মের তিনি বিরোধিতা করেছেন, যে দেশের পবিত্র মাটির সাথে ত্রিশ লাখ শহীদের রক্ত মিশে আছে সেখানে গোলাম আযমের কবর দেয়াটা মোটেও সমীচীন নয়। গোলাম আযম বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি অভিশপ্ত চরিত্র। বাংলাদেশের মানুষ এই চরিত্রটিকে চিরদিন রাজনীতির একজন খলনায়ক হিসেবেই মনে রাখবেন। ২৫ অক্টোবর, ২০১৪ লেখক : গবেষক ও বিশ্লেষক।
×