ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

একুশ শতক ॥ হাওড় বাংলার রূপান্তর

প্রকাশিত: ০৪:৪৭, ২৬ অক্টোবর ২০১৪

একুশ শতক ॥ হাওড় বাংলার রূপান্তর

মোস্তফা জব্বার ॥ তিন ॥ এর আগে দুই কিস্তিতে আমরা বাংলাদেশের হাওড় অঞ্চলের একটি গ্রাম ও তার আশপাশের অঞ্চলের রূপান্তরের কিছু কথা বলেছি। এবার এটি শেষ পর্ব। এরই মধ্যে নিশ্চয়ই জানা হয়ে গেছে যে, নেত্রকোনা জেলার খালিয়াজুরী থানার কৃষ্ণপুরে আমার পৈত্রিক বাড়ি। এটি বাংলাদেশের প্রত্যন্ত হাওড় এলাকার গভীরে অবস্থান করে। ইতিহাস বলে, এটি প্রাচীনকালের কালিদহ সাগরের অংশ ছিল। বেহুলার বাসর ঘর ছিল সেখানে। সাপ আর বন্যপ্রাণী ছাড়া ওখানে কোন মানুষ বাস করত না। দেশের ৭টি জেলার যে কয়টি উপজেলার পুরোটাই হাওড়ে তার মাঝে খালিয়াজুরী একটি। ৯০টি গ্রামের এই উপজেলাটিতে উপজেলা সদর, মেন্দিপুর, সাতগাঁও এবং আমার গ্রাম কৃষ্ণপুর ছাড়া আর কোথাও সারা বছর চলার মতো এক কিলোমিটারের বেশি সড়কপথ এখনও নেই। বলা হয়ে থাকে যে, একটি ভূমিকম্পে এই অঞ্চলটি তৈরি হয়েছে। ১৭৬২ সালের ভূমিকম্পে এর ভূপ্রাকৃতিক পরিবর্তন হয় বলে অনেকেই মনে করেন। এই অঞ্চলটি প্রত্যন্ত ও দুর্গম বলে দুশো বছর আগেও এখানে জনবসতি ছিল না বলা যায়। ভৈরবের ভাটি (ভাটি বলতে হাওড় অঞ্চলকে বোঝানো হয়। ভৈরব থেকে নরসিংদীর দিকে মেঘনার ভাটিতে) থেকে বিপুলসংখ্যক মানুষ সেই সময়ে ঐ এলাকায় বসবাস করা শুরু করে যারা আবাদী নামে পরিচিত। ১৭৬২ সালের ভূমিকম্পের ফলে এই এলাকায় ব্রহ্মপুত্র গতিপথ পরিবর্তন করে বলে অনেকের ফসলী জমি কমে যায় এবং সেই কারণে তারা আবাদী হয় বলে মনে করা হয়। আমার দাদাও তেমন একজন আবাদী। এই গ্রাম থেকে ঢাকা আসতে এক সময়ে ৩ দিন ৩ রাত সময় লাগত। এর মাঝে ৩০ কিলোমিটার পথ ছিল যেটুকুতে হেমন্তকালে হাঁটা ও বর্ষাকালে নৌকা ছাড়া বিকল্প কোন উপায় এখনও নাই। এই পথটা হেঁটে পাড়ি দিতে একদিন যেত। পরের দিন লেগে যেত লঞ্চে-আজমিরীগঞ্জ থেকে ভৈরব। এর পরের দিন ভৈরব থেকে ট্রেনে ঢাকা আসতে হতো। আমার নানার বাড়ি ছিল আশুগঞ্জে। নৌকায় যদি আসতাম তবে পুরো ২ রাত ৩ দিন নৌকায় থাকতে হতো। এবার ঢাকা থেকে বাড়ি গেলাম আট ঘণ্টায়। সড়কপথে সাত ঘণ্টা আর নদীপথে এক ঘণ্টা। সামনের দুয়েক বছরে নদীপথটার আর দরকার হবে না। গাড়ি নিজের বাড়ির উঠানেই যাবে। ১৯৬১ সালে আমি আমার বাড়ির চারপাশে প্রায় ৪০ কিলোমিটারের মাঝে একটি হাইস্কুল পাইনি ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ার জন্য। সেই সময়কার হাওড়ের বিবরণ তুলে ধরা হলে মনে হবে যে, এটি মানুষের আদি সভ্যতার সময়কালের কথা বলা হচ্ছে। হতে পারে আমাজনের জঙ্গল। আমি আমার পুরো গ্রামে একজন মাত্র মানুষকে জুতো পায়ে দিতে দেখতামÑ সেটি আমার বাবা। পুরো গ্রামের কোন মানুষকে ব্রাশ বা পেস্ট দিয়ে দাঁত মাজতে দেখিনি। গ্রামটিতে দুয়েকটা টিনের ঘর ছাড়া সব ঘরই ছিল ছনের। আমার এক চাচার একটি দোতলা দালান ছিল। সেই দালানের জন্য ইট আনা হয়েছিল শত মাইল দূর থেকে। বৈশাখ মাসের শুরুতে গ্রামের মানুষের প্রধানতম কাজ ছিল হাওড় থেকে ছন কেটে এনে ঘরের ছাদ ঠিক করা। আমার নিজের গ্রামে লেখাপড়ার হার বলতে কিছু ছিল না। আমার চাচাত ভাইদের মাঝে আমার আগে মোট ৪ জন ম্যাট্রিক পাস করেছেন। এঁদের একজন এইচএসসি পাস করেছেন। আমার সঙ্গে আরেক চাচাত ভাই এসএসসি পাস করেন। আমাদের গ্রামের প্রথম গ্র্যাজুয়েট ছিলেন আমার ফুফাত ভাই, যিনি আবার আমার বড় বোনের স্বামীও। আমার আগে অন্য বাড়ির মোট ২ জন ম্যাট্রিক পাস করেন। এছাড়া আর কেউ কোন পাসটাস করেনি। গ্রামে মেয়েদের লেখাপড়া নামক কিছু ছিল না। আমার চাচাত বোনরা কেউ প্রাথমিক বিদ্যালয় অতিক্রম করেননি। গ্রামের প্রথম মহিলা ¯œাতক আমার ছোট বোন হেলেন আর মেয়েদের মাস্টার্স পাস করা, প্রকৌশলী, স্থপতি বা ডাক্তার হওয়ার পালাটা আমাদের সন্তানদের সময় থেকে শুরু হয়েছে। গ্রামের মেয়েদের ১২-১৪ বছর বয়স হলেই বিয়ে দেয়াটা অতি সাধারণ ঘটনা ছিল। আদিবাসীদের মতো গামছার লেংটি পরা মানুষ হাওড়ে চোখে পড়তই। প্রতিবছর চৈত্র মাসে পুরো এলাকায় দুর্ভিক্ষ বিরাজ করত। গ্রামের মানুষের কাছে সুপেয় পানি বলতে কিছু ছিল না। স্যানিটেশন ব্যবস্থা নামক কিছু কেউ জানত না। প্রায় দু’শ’ বছর আগে গ্রামে প্রথমে একটি মক্তব চালু হয়। আমার দাদা আলিমুদ্দীন মুন্সি সেটি চালু করেন। এরপর চালু হয় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়। একসময়ে কবরস্থান ছিল না বলে মানুষের লাশ ভাসিয়ে দিতে হতো। পরে কবরস্থান ও ঈদগাহ দুটোই গড়ে ওঠে। বাবা গড়ে তোলেন দুটোই। আমি যখন ১৯৬০ সালে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ি তখন আমার সঙ্গে আমাদের গ্রামের একজন ছাত্র ছিলেন। পাশের গ্রামের দুইজন ছাড়াও বাইরে থেকে মামার বাড়িতে বেড়াতে আসা একজন ছাত্রী আমার সঙ্গে পড়তেন। পুরো গ্রামটা খালে ভরা ছিল। মানুষ এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়ি সাঁকোতে যেত। কৃষিপ্রধান বলে গরু-বাছুর তো ছিলই-জ্বালানির জন্য গোবরের চট লেপা একটি অতি সাধারণ কাজ ছিল। গ্রামে একটি হাট ছিল। সেই হাটে কাপড় কাচার বল সাবান, তেল, গুড় ও অতি প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী ছাড়া আর কিছু পাওয়া যেত না। যারা বাংলাদেশের হাওড় এলাকা সম্পর্কে জানেন তাদের অবহিত থাকার কথা যে, এলাকাটি কেবল নি¤œাঞ্চল নয়, প্রত্যন্ত ও দুর্গম। ভৈরব রেলসেতুর নদী শাসনের জন্যও এই এলাকা প্লাবিত হয়েছে বলে মনে করা হয়। সম্ভবত হাজার বছর আগেও এখানে কোন বসতি ছিল না। গারো পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত এই অঞ্চলটি জঙ্গলাকীর্ণ থাকায় মানুষ বসবাস করতে পারত না। স্থানীয়রা সংখ্যায় কম থাকায় এখন বস্তুত এই আবাদীদেরই প্রভাব বেশি। মূলত নি¤œবর্ণের হিন্দুদের দ্বারা অধ্যুষিত এই এলাকায় এখন অবশ্য আবাদী-মুসলমানের সংখ্যা ব্যাপক। সেই এলাকাটির নতুন রূপ এ রকম : পুরো এলাকা ঘুরে একটি ছনের ঘর পেলাম না। সত্যি সত্যি কৃষ্ণপুর গ্রাম তো নয়ই তার পাশের গ্রাম কল্যাণপুর, মামুদনগর; কোথাও একটি ছনের ঘর নেই। মনে পড়ে, প্রতিবছর কার্তিক মাসে মহামারী লেগেই থাকত। গ্রামের পর গ্রাম কলেরায় উজাড় হয়ে যেত। বাবাকে দেখতাম দিনের পর দিন মানুষের বাড়িতেই থাকতেন। এখন সেখানে ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্র তো আছেই গ্রামের বাজারসহ সব বাজারেই আছে ফার্মেসি। রোগাক্রান্ত মানুষ চোখে পড়ল না একটাও। এই গ্রামেরই দুটি মেয়ে ডাক্তার হয়েছে। এই দুজনের একজন ইথিওপিয়ায় এবং অন্যজন নেদারল্যান্ডসে। আরও আধা ডজন ছেলেমেয়ে ডাক্তারী পড়ছে। একজন ছেলে ডাক্তার ফেনীতে সরকারী হাসপাতালে কাজ করে। গ্রামের বাজারে এক গাদা কম্পিউটারের দোকান। আছে মোবাইলের দোকান; বিক্রি আর মেরামত দুটোই হয় এসব দোকানে। প্রতি সপ্তাহে বাজারে মাল আসে কোটি টাকার। বিলাসী তরল পানীয় থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব্জির কোনটাই বাদ যায় না। এমনকি ফার্মের মুরগি, পুুকুরের পাঙ্গাশ বা রসায়নে ভরা আমের রমরমা বাজার জমে ওঠে প্রতিদিন। এই গ্রামের মানুষ চৈত্র মাসে কচুঘেঁচু খেয়ে বেঁচে থাকত। এখন কচুঘেঁচু তো দূরের কথা, অভাবের চেহারা দেখে না কেউ। এখন সেই গ্রামে কখনও অভাব আসে না। গ্রামের কামলাদের মাসিক আয় ১৫ হাজার টাকার কাছাকাছি। বর্ষায় যখন কাজ থাকে না তখন ওরা চলে আসে গ্রামের বাইরে। সেখানেও দিনে ৮০০ টাকা পর্যন্ত কামাই করা যায়। শুধু ঈদের সময় গ্রামে রেমিটেন্স আসে কোটি টাকার। শিক্ষার হার পৌঁছেছে হাওড় এলাকার সর্বোচ্চ। গ্রামের শতভাগ শিশু স্কুলে যায়। যে গ্রামে হাইস্কুল ছিল না সেই গ্রামে একটি ছেলেদের ও একটি মেয়েদের হাইস্কুলের পাশাপাশি একটি ডিগ্রী মাদ্রাসা ও একটি পোস্টগ্র্যাজুয়েট কলেজ রয়েছে। ৩টি কেজি স্কুল এবং ৩টি প্রাইমারী স্কুল তো আছেই। গ্রামের একটি প্রাইমারী স্কুলে পেলাম এক জোড়া ভাইবোনকে। ওদের বাবা দিনমজুর। বোনটা ফাইভে আর ভাইটা ফোরে পড়ে। মেয়েটার ইচ্ছা সে ডাক্তার হবে আর ছেলেটা হবে শিক্ষক। গ্রামের রাস্তায় দুদিন হেঁটে হেঁটে স্কুলের ড্রেস পরা শিশুদের দেখে, কথা বলে জানলামÑ অনেকেই কেজি স্কুলে পড়ে। মাসিক বেতন দু’শ’ টাকা। পুরো গ্রামে মানুষ বাস করে হয়ত ৪ হাজার অথচ সেই গ্রামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে লেখাপড়া করে তার চাইতে বেশি ছেলেমেয়ে। প্রত্যন্ত হাওড়ের পাড়ে এমনকি মেয়েরা হোস্টেলে থেকে কলেজে লেখাপড়া করছে বহু দূর-দূরান্ত থেকে এসে। সেই গ্রামেরই মেয়ে হাসিনা আক্তার। দেখা হলো গ্রামের হাটে। একটি সব্জির দোকানে বসে আলু মাপ ছিল। জানতে চাইলাম, কে চালায় দোকানটা? জানাল সে ও তার বাবা। মালপত্র কোত্থেকে আসে এমন প্রশ্নের জবাবে জানাল, ভৈরব থেকে। সহজাত প্রশ্ন করলাম, তুমি কি ভৈরব থেকে মাল কিনে আনো? না, আমি বা বাবা কেউ ভৈরব যাই না। একটা মোবাইল ফোন দেখিয়ে বলল, আমাদের জিনিসপত্র আসে এই মোবাইলের অর্ডারে। আমিই বলে দেই কী কী কতটা দিতে হবে। টাকা দাও কেমন করে? এই প্রশ্নের জবাবে হাসিনা জানাল, সেটাও মোবাইলে? বাংলাদেশে এখন দৈনিক ৩৩৩ কোটি টাকা শুধু মোবাইলেই লেনদেন হয়। হাসিনাকে দেখে আমার বিস্ময়ের সীমা ছিল না। মনে হচ্ছিল, আমি কৃষ্ণপুরে নয়, কোন এক ভিন্নগ্রহে এসেছি। যে গ্রামে মাত্র ৫০ বছর আগে একজন ছাত্রী পাইনি, সেই গ্রামের সকল মেয়ে লেখাপড়া করে আর কিশোরী মেয়ে হাসিনা লেখাপড়ার পাশাপাশি বাড়িতে বসে ডিজিটাল উপায়ে ব্যবসা করে, এমনটি আমার নিজের স্বপ্নেই ছিল না। আমি আমার দাদার কথা ভাবী। একদিন খালি হাতে শুধু একটি মক্তব করার সামর্থ্য নিয়ে যিনি এই গ্রামে এসেছিলেন, তাঁর গ্রামটি তিনি এখন যদি দেখতেন তবে চিনতে পারতেন বলে আমার মনে হয় না। এরপরও কি আমরা বলব দেশটা বদলায়নি? (সমাপ্ত) ঢাকা, ২৫ অক্টোবর ২০১৪ লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যারের জনক ॥ ই-মেইল : [email protected], ওয়েবপেজ:www. bijoyekushe.net,ww w.bijoydigital.com
×